মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই জ্ঞানপিপাসু ও কৌতূহলী। সে কারণে সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ তার পরিবেশ, প্রকৃতি ও আশপাশ সম্পর্কে জানার তীব্র আকাক্সক্ষায় এক স্থান থেকে আরেক স্থানে গমন করেছে। কখনো বাণিজ্যের উদ্দেশে, কখনো জীবিকা অর্জনের তাগিদে, কখনো বা জানার আগ্রহে। এই গমন বা ভ্রমণকেই ইসলামি পরিভাষায় বলা হয় ‘সফর’। সফর শুধু সময় কাটানোর মাধ্যম নয়, বরং ইসলামে এটি একটি জ্ঞানার্জনের গুরুত্বপূর্ণ পন্থা ও ইবাদতের উপায় হিসেবেও বিবেচিত।
পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে আল্লাহতায়ালা মানুষকে পৃথিবীতে ভ্রমণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং পূর্ববর্তীদের অবস্থান, তাদের ইতিহাস ও পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনার আহ্বান জানিয়েছেন। কোরআনের ভাষায়, পৃথিবী জুড়ে ভ্রমণ করে মানুষ যেন অনুধাবন করতে পারে সৃষ্টির সূচনা কেমন ছিল, আল্লাহর শক্তি ও কুদরত কত বিস্ময়কর এবং যারা সত্য প্রত্যাখ্যান করেছিল, তাদের কী পরিণতি হয়েছিল।
ভ্রমণের এই গুরুত্বের কারণে ইসলামি সভ্যতায় বহু মনীষী জ্ঞানার্জনের জন্য অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। মুহাদ্দিসরা হাদিস সংগ্রহের জন্য মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়েছেন। ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে ভ্রমণ ছিল একদিকে আত্মশুদ্ধি, অন্যদিকে অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস জানার মাধ্যম। ফলে মুসলিম বিশ্বে ভ্রমণ হয়ে ওঠে এক গৌরবময় সংস্কৃতি।
শুধু তাই নয়, সফরের মাধ্যমে মানুষ যেমন পৃথিবীর বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য অবলোকন করতে পারে, তেমনি সৃষ্টিকর্তার কুদরত সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি লাভ করে। এটি তার ইমানকে মজবুত করে, চিন্তা ও মননশক্তিকে প্রসারিত করে। এ কারণেই ইসলাম সফর করতে উৎসাহিত করেছে এবং সফরকালে নামাজে ছাড়, রোজা ভঙ্গের সুযোগ ইত্যাদি বিধানের মাধ্যমে সফরকে সহজ করে দিয়েছে।
অসংখ্য নবী-রাসুল ও জ্ঞানী-গুণীদের নাম পাওয়া যায়, যারা পৃথিবীর নানা প্রান্ত ভ্রমণ করে ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। ইসলামে ভ্রমণকে সফর বলা হয়। নিজ বাসস্থান থেকে ৪৮ মাইল দূরত্বে গমনের উদ্দেশ্যে নিজ মহল্লা থেকে বের হওয়াকে সফর বলে। ভ্রমণকারীকে বলা হয় মুসাফির। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং অনুধাবন করো, কীভাবে তিনি সৃষ্টির সূচনা করেছেন? অতঃপর আল্লাহ সৃজন করবেন পরবর্তী সৃষ্টি। আল্লাহ তো সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ (সুরা আনকাবুত ২০)
সফরে বের হওয়ার পর কারও গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র হয়, তবে সেখানে পৌঁছার পর আর মুসাফির থাকবে না। আর গন্তব্য যদি নিজ বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র না হয় এবং সেখানে অন্তত ১৫ দিবস-রজনী থাকার নিয়ত না থাকে, তাহলে সফর অবস্থা বহাল থাকবে। ভ্রমণ একটি আনন্দময় ইবাদত এবং জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার উৎস। সফর বা ভ্রমণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ হলো পূর্ববর্তীদের কীর্তি ও পরিণতি সম্বন্ধে জানা ও শিক্ষা গ্রহণ করা।
এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘তারা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না এবং তাদের পূর্ববর্তীদের কী পরিণাম হয়েছিল, তা কি দেখে না? যারা মুত্তাকি তাদের জন্য পরকালই শ্রেয়, তোমরা কি বোঝো না? ’ (সুরা ইউসুফ ১০৯) অন্যত্র মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, ‘এরা কি পৃথিবীতে ভ্রমণ করে না? করলে দেখত এদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছিল। পৃথিবীতে তারা ছিল এদের অপেক্ষা শক্তিতে ও কীর্তিতে প্রবলতর। অতঃপর মহান আল্লাহ তাদের শাস্তি দিয়েছিলেন তাদের অপরাধের জন্য এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে তাদের রক্ষা করার কেউ ছিল না।’
ভ্রমণ বা সফরের বিশেষ উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টির রহস্য অবলোকন করে জ্ঞানার্জন করা এবং তার কুদরত ও শক্তির প্রতি অনুগত হওয়া। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা কি দেশ ভ্রমণ করে না? তাহলে তারা জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন ও শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন হতে পারত। বস্তুত চক্ষু তো অন্ধ নয়, বরং অন্ধ হচ্ছে হৃদয়।’ (সুরা হজ ৪৬)
যাতায়াত ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যানবাহন ও পরিবহন আল্লাহর কুদরতেরই অংশ এবং তাও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে। পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তাদের প্রতি এবং যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম, যেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম, ওই সব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং তাদের বলেছিলাম, তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিবস ও রজনীতে।’
ইসলামি স্কলারদের মতে, সব মুসলমানের জন্য আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে সামর্থ্য অনুযায়ী সফর ও ভ্রমণ করা কর্তব্য। আল্লাহতায়ালা কোরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের পূর্বে বহু বিধান-ব্যবস্থা গত হয়েছে, সুতরাং তোমরা পৃথিবী ভ্রমণ করো এবং দেখো মিথ্যাশ্রয়ীদের কী পরিণাম!’ (সুরা আলে ইমরান ১৩৭)
সফরের মাধ্যমে দেশ-বিদেশের বৈচিত্র্য বিষয় অবলোকন করে জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করা যায়। সফরের মাধ্যমে মানুষের চোখ-কান খুলে যায়। সত্য, সঠিক পথ ও পন্থা গ্রহণে সহায়ক হয়। আল্লাহতায়ালা সুরা হজে ইরশাদ করেন, ‘তবে কি তারা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করে না, যাতে তাদের অন্তর অনুধাবন করতে পারত এবং তাদের কান (সত্য কথা) শুনে নিত।’