অর্থনীতি প্রতিবেদক :
গ্রীষ্মের বাহারি ফল আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, জামরুল আর তালে বাজার এখন টইটম্বুর। বিক্রেতারা পসরা সাজিয়ে বসেছেন ফলের ডালি নিয়ে। তবে মৌসুমের শুরুতেই এসব ফল বিক্রি হচ্ছে চড়া দামে, যা ক্রেতাদের জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে আমের ভরা মৌসুম চললেও দাম বেশ চড়া, যা অনেককেই হতাশ করছে। ফলের প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ থাকলেও কেনায় বাধ সাজছে দাম।
ক্রেতাদের অভিযোগ, ফলমূলে মানুষের আগ্রহ থাকায় সুযোগ নিচ্ছেন বিক্রেতারা। তবে বিক্রেতারা বলছেন, কেনা দাম বেশি, তাই বাধ্য হয়েই বিক্রি করতে হচ্ছে বেশি দামে।
মঙ্গলবার (১০ জুন) বিকেলে রাজধানীর বাড্ডা, রামপুরা ও আফতাবনগর গেট সংলগ্ন ফলের বাজার ঘুরে এসব তথ্য জানা গেছে।
জানা গেছে, সাধারণত গ্রীষ্মের আগমনের পূর্বেই বাজারে আসতে শুরু করে আম, কাঁঠাল, লিচু, জামসহ বিভিন্ন ধরনের ফল। এছাড়াও এই সময় পাওয়া যায় জামরুল, তালশাঁস, ডেউয়া, ছবেদা, করমচা, অড়বরইয়ের মতো দেশি ফল। রয়েছে বিভিন্ন রকমের বারোমাসি ফলও। কিন্তু মৌসুম হওয়ার পরও বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে এসব ফল।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বাজারে নানা জাতের ফল থাকলেও এখন আমের প্রচুর চাহিদা। যারাই আম কিনতে আসেন, ৪-৫ কেজির কম আম খুব অল্প মানুষই কেনেন। দেশে বড় একটা সংখ্যক আমপ্রেমী আছেন, যারা তৃপ্তি মেটাতে পাইকারি বাজার থেকে আমের ক্যারেট কেনেন।
আফতাবনগর গেট সংলগ্ন ফলের বাজারে কথা হয় মফিজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন পুরোপুরি আমের সিজন, কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় ঢুকতে ঢুকতে আমের অবস্থা অনেকটাই খারাপ হয়ে যায়। তারপরও নিয়মিত কেনা হয়, খাওয়া হয়।
দাম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দামটা তুলনামূলক এই জায়গাতে একটু বেশি। তবে, কারওয়ানবাজারসহ অন্যান্য বাজারে গেলে আবার কিছুটা দাম কম। আমাদের প্রত্যাশা হলো, যেহেতু এখন ফলমূলের সিজন, সব ধরনের ফলের দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। এখান থেকে যে আমটা ১০০ টাকা নিচ্ছে, এটা ৮০ টাকা হলে ঠিক ছিল। তারপরও বাসার জন্য কিছু নিতে হয়, কী আর করা যাবে।
রফিকুল ইসলাম নামে আরেক ক্রেতা বলেন, যেহেতু এখন আম-লিচুর সিজন, তাই এসব ফলে মানুষের আগ্রহটা একটু বেশি। এই সুযোগটাই নিচ্ছে ক্রেতারা। যেই আমটা রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ থেকে তারা কিনে আনছে ৫০-৬০ টাকা কেজি, সেটাই ঢাকায় এনে বিক্রি করছে দুই থেকে তিনগুণ দামে। এগুলো মানুষকে ঠকানো ছাড়া আর কিছুই না।
দাম বেশি, কিন্তু ‘কিছুই করার নেই’
এদিকে মৌসুম অনুযায়ী ফলের দাম বেশি—ক্রেতাদের এমন অভিযোগ থাকলেও ‘কিছুই করার নেই’ বলছেন ব্যবসায়ীরা। মো. সাগর নামে এক বিক্রেতা বলেন, এখন আমের চাহিদা ভালো, কিন্তু রেট (মূল্য) বেশি। এবার গতবারের চেয়ে আমের উৎপাদন অনেক বেশি। সেইসাথে মানুষের চাহিদাও বেশি। দাম বেশি হওয়ার কারণ হলো, আমাদের বেশি দামে কিনে আনতে হচ্ছে। যেকারণে চাইলেও কমে বিক্রি করার সুযোগ নেই।
দাম কমবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ধীরে ধীরে তো আম শেষ হয়ে যাচ্ছে। রাজশাহী থেকে এই মুহূর্তে আমের দাম কমানোর সম্ভবনা খুবই কম। আমরা আশঙ্কা করছি সামনে হয়তো বরং দাম আরও বাড়তে পারে।
বাজারে কোন আমের চাহিদা বেশি, এমন প্রশ্নের জবাবে সাগর বলেন, বাজারে এখন রূপালী, হিমসাগর, ল্যাংড়া, লকনা আম আছে। এরমধ্যে মানুষের বেশি চাহিদা হিমসাগর ও ল্যাংড়া আমে। আমি হিমসাগর বিক্রি করছি ১২০ থেকে ১৪০ টাকা, আর ল্যাংড়া আম বিক্রি করছি ১০০ টাকা। এছাড়াও আমরূপালী ৮০ থেকে ১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি।
আনিসুর রহমান নামে আরেক ফল বিক্রেতা বলেন, বাজারে কিছুদিনের মধ্যেই যুক্ত হবে হাঁড়িভাঙা আম। ধীরে ধীরে যখন অন্যান্য আমগুলো শেষ হয়ে আসবে, তখন বাজারে রাজত্ব করবে এই আম। এখন যেগুলো হাঁড়িভাঙা নামে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলোর অধিকাংশই ভুয়া। আর কিছু থাকলেও সেগুলো অপরিপক্ক।
তিনি আরও বলেন, আমের সিজন আরও মাস দুয়েক থাকবে। বর্তমানে আমরা হিমসাগর, ল্যাংড়া, রূপালী আম বিক্রি করছি। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে হিমসাগর। প্রতি কেজি হিমসাগরের দাম ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। আর রূপালী আম বিক্রি করছি ১২০ টাকা, ল্যাংড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকা।
৪০০ টাকার নিচে বাজারে লিচু নেই
জানা গেছে, সাধারণত মে থেকে জুন মাসের মধ্যেই বাজারে পরিপক্ব লিচু পাওয়া যায়। দেশে রাজশাহী, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, ময়মনসিংহ, ঢাকার সোনারগাঁ, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলায় লিচুর চাষ হলে দিনাজপুরে উৎপাদিত লিচুকেই দেশের সেরা লিচু বলে দাবি করেন সেখানকার চাষিরা।
আজকের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি ১০০ পিস লিচু বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা পর্যন্ত। লিচুর দাম প্রসঙ্গে বিক্রেতা মো. আজিম মিয়া বলেন, বর্তমানে ১০০ লিচু বিক্রি করছি সর্বনিম্ন ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকা দামে। লিচু ভেদে দামও একেকরকম। আগে দাম কিছুটা কম ছিল, কিন্তু এখন তো সিজন শেষের দিকে, তাই দামটা বেড়ে গেছে। সামনের দিনে হয়তো আরও বেড়ে যাবে।
বাজারে লিচুর চাহিদা কেমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দাম একটু বেশি হলেও ভালো লিচুর চাহিদা বেশি। প্রতিদিন অন্তত পাঁচ থেকে ছয় হাজার লিচু আমি বিক্রি করি। লাভও থাকে মোটামুটি।
ক্রেতা কম কাঁঠালের, কমেও বিক্রি হচ্ছে না
ফলের বাজারে অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে জাতীয় ফল কাঁঠাল। বাজারে আম-জাম আর লিচুতে ব্যপক চাহিদা থাকলেও কাঁঠালের কাছে খুব বেশি ভিড়তে দেখা যায় না মানুষকে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে চলমান মাত্রাতিরিক্ত গরমের কারণে কাঁঠালের খুব বেশি চাহিদা নেই।
কাঁঠাল বিক্রেতা মো. ইব্রাহিম হোসেন বলেন, মানুষ অন্যান্য ফল কিনলেও কাঁঠালে এইবার চাহিদা খুবই কম। কম দিয়েও বিক্রি করা কঠিন। যে সাইজের কাঁঠাল গত বছর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা বিক্রি করেছি, সেটি এবছর ২০০ টাকায়ও বিক্রি হচ্ছে না।
বিক্রি কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশে গত কয়েকদিন মাত্রাতিরিক্ত গরম পড়ছে। সবার ধারণা কাঁঠাল খেলে আরও বেশি গরম অনুভূত হয়। এজন্যই হয়তো কাঁঠালের চাহিদা কম।
বাজারে মিলছে আরও যেসব গ্রীষ্মকালীন ফল
বাজারে পাওয়া যাচ্ছে গ্রীষ্মকালীন আরেক ফল জাম। প্রতি কেজি জাম পাওয়া যাচ্ছে ১২০ টাকা থেকে ১৬০ টাকায়। এছাড়া রয়েছে রসালো জামরুল, যা প্রতি কেজি ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। সঙ্গে গাবও এসেছে, বিক্রি হচ্ছে জামরুলের মতো দামে। পাশাপাশি প্রতি পিস আনারস বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৮০ টাকা।
তাল গ্রীষ্মের আরেকটি ফল। আকারে বড় শাঁসসহ তাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি শাঁসের দাম পড়ছে প্রায় ১৫ টাকার মতো। আর আকারে ছোট তাল পিস ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।