দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। পাপন দুর্নীতির অলরাউন্ডার রাজনীতিবিদ - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

বুধবার, ২৫ জুন, ২০২৫

পাপন দুর্নীতির অলরাউন্ডার রাজনীতিবিদ


ক্রাইম প্রতিবেদক:

দেশের তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটের  অন্যতম ধনী সংস্থা  বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। অডিট রিপোর্ট বলছে, বিসিবি ২০১২ সালের অক্টোবর থেকে গত বছরের জুলাই পর্যন্ত ব্যয় করেছে ২ হাজার ৭৭২ কোটি টাকা। এই এক যুগে বিসিবির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এবং যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন। আর বিপুল এই অর্থ খরচের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিলেন পাপন। সঙ্গে ছিলেন তার সাঙ্গোপাঙ্গরা। প্রাপ্ত নথি বলছে, বিসিবিতে শুধু চুরি নয়; হয়েছে সাগরচুরি। যেমন শুধু বল কিনে ব্যয় করেছে ৯২ কোটি টাকা, আবার তেমনি বোর্ড সভায় ১৯ কোটি, সাধারণ সভায় সাড়ে ১১ কোটি টাকা  খরচ  করা হয়েছে। তারপরও গায়েব হয়ে গেছে বিপিএলের হিসাবে থাকা ১১৩ কোটি টাকা। 


 দেশের ক্রিকেট অঙ্গনে ঘটে যাওয়া ওইসব বেশুমার অনিয়ম-দুর্নীতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রাথমিকভাবে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে ২৭ খাতের নির্দিষ্ট তথ্য চেয়েছে কমিশনের তদন্ত দল। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বে চলছে বিশেষ অনুসন্ধান। পাশাপাশি কালবেলার অনুসন্ধানেও উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর বহু তথ্য, যা একেবারে পিলে চমকানোর মতো। যেখানে এক বছরের ৩৩ পাতার অডিট রিপোর্টের জন্য ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা আর মুজিববর্ষের কনসার্টের নামে লুট হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। তা ছাড়া পাপন নিজে বিসিবির টাকায় ৫২ বার বিদেশ সফর করেছেন। এই সফরে তিনি দৈনিক ভাতা নিয়েছেন ৪০০ ডলার করে। টাকার হিসাবে যা প্রায় ৫০ হাজার টাকা। 


অনুসন্ধানের অগ্রগতি জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক মো. সাঈদুজ্জামান বলেন,  আমরা ২৭ ধরনের তথ্য চেয়ে বিসিবিতে চিঠি দিয়েছি। কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। বিসিবির সভাপতি পদ খালি থাকাসহ নানা কারণে কিছু তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। আমরা তাদের সব নথি সরবরাহের জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছি।  তিনি আরও বলেন,  আমাদের অনুসন্ধান দল ছাড়াও কমিশনের এনফোর্সমেন্ট শাখা বিসিবিতে কয়েক দফায় এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালনা করেছে। তারা বেশকিছু অনিয়ম জালিয়াতির তথ্য পেয়েছে।  


 কমিশনের অন্য উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম বলেন,  নাজমুল হাসান পাপন সংশ্লিষ্ট অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বিসিবির কাছে নথি তলব করা হয়েছে। তারা কিছু তথ্য দিয়েছে। কমিশনের অনুসন্ধান দল অনুসন্ধান শেষে একাধিক মামলার সুপারিশসহ কমিশনের প্রতিবেদন পেশ করবে। সে আলোকে দুর্নীতিতে জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।  


 মিডিয়ার অনুসন্ধানে দেখা যায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী ছিলেন নাজমুল হাসান পাপন। তার নেতৃত্বাধীন বিসিবির বোর্ড পরিচালকদের অধিকাংশই অর্থ আত্মসাৎ, অনিয়ম ও দুর্নীতিতে ব্যস্ত ছিলেন। রাজধানী সংলগ্ন পূর্বাচল স্টেডিয়াম নির্মাণের জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেওয়া, বিপিএলের মতো টুর্নামেন্টকে লাভজনক না করে নিজেদের অবৈধ আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার, মুজিববর্ষের নামে শতকোটি টাকা লোপাটের উদ্দেশ্যে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় করেছেন পরিচালকরা। 


 পাপনের অনিয়ম ও অযাচিত ব্যয় : দুদক যে ২৭ ধরনের নথি তলব করেছে, সেখানেই দেখা যায় বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সম্পৃক্ততা। মিডিয়ার অনুসন্ধানের তথ্যমতে, পাপন বিসিবির সভাপতি হিসেবে ১২ বছরে ৫২ বার বিদেশ সফর করেন। আইসিসি ও এসিসি সভার বাইরেও অনেক দ্বিপক্ষীয় সিরিজেও তার বিরুদ্ধে বোর্ডের অর্থ ব্যয় করার তথ্য মিলেছে। তিনি বিজনেস ক্লাসের এয়ার টিকিট ছাড়াও প্রতিদিন বোর্ড থেকে ৪০০ ডলার দৈনিক ভাতা (ডিএ) ও ভ্রমণ ভাতা (টিএ) গ্রহণ করেছেন। আইসিসির দুই দিনের একটি সভায় যোগ দিয়ে তিনি বোর্ড থেকে তুলে নেন ১২ দিনের টিএডিএ। আইসিসির চারটি মেগা টুর্নামেন্টে টিকিট কিনতে পাপন ব্যয় করেন ৭ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ টিকিটের ব্যয় ছিল রেকর্ড পরিমাণ ৩ লাখ পাউন্ড, টাকার হিসাবে যা প্রায় ৫ কোটি টাকা। বিসিবির বার্ষিক সাধারণ সভায় (এজিএম) অস্বাভাবিক খরচ করেন পাপন। শেষ তিন এজিএমে খরচ করেন ১১ কোটি ১৮ লাখ টাকা। ২০২১ সালে নির্বাচনী এজিএমে ব্যয় করেন ৪ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এ ছাড়া পরের দুই এজিএমে খরচ করেন ৩ কোটি ২৯ লাখ ও ৩ কোটি ৫৭ লাখ। 


 ১৩ বছরে মোট ছয়টি অডিট ফার্মের মাধ্যমে বিসিবির আয়-ব্যয়ের অডিট করেছিল বিসিবি। সর্বশেষ ৪৬ লাখ টাকা খরচে করা অডিট করা হাওলাদার ইউনুস অ্যান্ড কোং বোর্ডের এক মৌসুমের ৪০০ কোটির বাজেটের মোট অডিট রিপোর্ট ছিল মাত্র ৩৩ পৃষ্ঠার। যার ১৮ পৃষ্ঠা ছিল পর্যবেক্ষণ আর ১৫ পৃষ্ঠায় ছিল সংক্ষেপে খাতওয়ারি আয়-ব্যয়ের হিসাব। পুরো বিষয়টিই অস্বচ্ছ বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। 


 দুদকে জমা হওয়া অভিযোগ অনুযায়ী, জাতীয় ক্রিকেট দলের আয়ারল্যান্ড সফরে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিরাপত্তার জন্য ৬৭ হাজার পাউন্ড ব্যয় করা হয়েছিল। অথচ দ্বিপক্ষীয় সিরিজের ক্ষেত্রে এই ব্যয় স্বাগতিক বোর্ড দেওয়ার কথা। অন্যদিকে, ২০১৯ সালে ক্রিকেট দলের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের ইংল্যান্ডে সফরের জন্য ব্যয় করা হয় দেড় কোটি টাকা। ২০১৬ সাল থেকে বিসিবি প্রেসিডেন্টের  হেলিকপ্টার ভ্রমণের খায়েশ  মেটাতে বিসিবিকে গুনতে হয়েছে সাড়ে ৩ কোটি টাকা। বিসিবির বোর্ড সভা বাবদ ব্যয় করা হয়েছে ১৯ কোটি টাকা; যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৯ কোটি খরচ হয় ক্রিকেট অপারেশন্স কমিটির সভা আয়োজনে। 


 পাপনের বিরুদ্ধে আরেকটি বড় অভিযোগ হচ্ছে, তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি। যে ব্যাপারে দুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেয়েছে দুদক এমনটাই সংস্থাটির সূত্রে জানা গেছে। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ক্রিকেট কমিটি অব ঢাকা মেট্রোপলিস (সিসিডিএম) তাদের ব্যাখ্যায় দুদককে জানিয়েছে, পাপনের আমলে যে ১৮ ক্লাব নিবন্ধন পেয়েছিল, তাদের কারোরই পে-অর্ডার ছাড়া আর কোনো নথিপত্র সঠিক ছিল না। এমনকি তাদের নির্দিষ্ট কোনো ক্লাব ভবনও নেই। অথচ এভাবে টিকে থাকা ১৫ ক্লাবের যারা কাউন্সিলরশিপ পেয়েছেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন পাপনের প্রতিষ্ঠান বেক্সিমকোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী। 


কর্মকর্তাদের হেঁয়ালীপনায় বিপিএলের জৌলুস হারাতে থাকে, কমে যেতে থাকে লাভের হার। মাঠে ও মাঠের বাইরে নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে বিপিএল। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আইপিএলের পরই সবচেয়ে জমজমাট হওয়ার কথা ছিল বিপিএল। কিন্তু পাপন দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ফিক্সিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেলেঙ্কারিতে জড়াতে থাকে বিপিএলের নাম। এক সময় আসরটি হয়ে ওঠে বোর্ডের পরিচালক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক রুটিরুজির উৎস। বোর্ড নয়, প্রাধান্য পায় কর্তাদের ব্যক্তিগত লাভ। 


 দুদক প্রাপ্ত অভিযোগের তদন্তে দেখা যায়, বিসিবির সাবেক পরিচালক শেখ সোহেল, ইসমাইল হায়দার মল্লিকসহ বিসিবির নানা স্তরের কর্মকর্তারা সরাসরি জড়িত ছিলেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে বিপিএল আয়োজন করে বোর্ডের প্রথম দুই আসরে আয় হয়েছিল মোট ৬৬ কোটি টাকা। বিস্ময়কর বিষয় হলো, পাপনের সময় থেকেই বিপিএল তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। এমনকি ২০১৩-১৪ মৌসুমে বিপিএল না করেও ব্যয় করা হয়েছিল ৩ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। টিকিট বিক্রিতে অপ্রতিরোধ্য দুর্নীতির কথা উহ্য রাখলেও কয়েক বছরের আসরে আয়-ব্যয়ের হিসাবে ১১৩ কোটি টাকার হদিসও মেলেনি। এই টাকা কীভাবে খোয়া গেল, কোথায় গায়েব হলো তার সদুত্তর দিতে পারছে না কেউ। 


 মুজিববর্ষ, কনসার্ট ও জন্মশতবার্ষিকীর নানা আয়োজনে দুর্নীতি 

 দুদকের অনুসন্ধানে অনিয়মের তথ্য মিলেছে মুজিব শতবর্ষের আয়োজনেও। দুদকের চিঠিতে এ-সংক্রান্ত তিনটি বিষয়ে তথ্য চাওয়া হয়েছে। মুজিব শতবর্ষে ভারতীয় সংগীত ব্যক্তিত্ব এ আর রহমানকে দিয়ে দুটি গানের অডিও ও ভিডিও রেকর্ড করিয়েছিল বিসিবি। একই সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে মিরপুরে বিশাল এক কনসার্টের আয়োজন করে বিসিবি। সেখানে শুধু গানের জন্যই অস্কারজয়ী কণ্ঠশিল্পী এ আর রহমানকে ৫ কোটি টাকা দিতে হয়েছে বিসিবির ফান্ড থেকে। ওই কনসার্টে এ আর রহমানের সহশিল্পীদের খাবারের জন্য খরচ করা হয়েছে ৮০ লাখ টাকা, যা বিস্ময়কর। কনসার্টের বাজেট নিয়েও মিলছে অবিশ্বাস্য সব তথ্য। ৭ কোটি টাকা বাজেটের আসরটি করোনার কারণে স্থগিত হওয়ার পরও বাজেট দাঁড়িয়েছিল ১৭ কোটি টাকায়। দুই বছর পর বোর্ডের পোস্ট ফ্যাক্টর পদ্ধতিতে কনসার্ট খাতে অতিরিক্ত ব্যয় দেখিয়ে আরও ৮ কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়। ফলে এই কনসার্টের মোট ব্যয় ২৫ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। আর মুজিববর্ষ উপলক্ষে বিশেষ বিপিএল আয়োজনে বোর্ডের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮৩ কোটি টাকা। 


 বোর্ডের টেলিভিশন স্বত্ব বিক্রিতে  কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট  

 দুদকের দেওয়া চিঠির সূত্র বলছে, বিসিবি বিভিন্ন স্বত্ব বিক্রির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার প্রমাণ তলব করা হয়েছে। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে বিসিবি লম্বা সময়ের জন্য টেলিভিশন বিক্রির উদ্দেশে বাজার যাচাই করতে একটি অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠানকে ৫০ হাজার ডলার চুক্তিতে নিয়োগ দিয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বাজার যাচাই শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল বিসিবির টেলিভিশন স্বত্বের বাজারদর ৪৯ মিলিয়ন ডলার। কিন্তু দেখা গেছে, দুদিন পরই জরুরি বোর্ড সভার মাধ্যমে পাপনের নেতৃত্বাধীন বোর্ড সেটাকে কমিয়ে ফ্লোর প্রাইজ নির্ধারণ করেছিল মাত্র ২০ মিলিয়ন ডলার। আর ওই সময়ই একজন বোর্ড পরিচালকের টেলিভিশন মাত্র ২০ দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলারে পেয়ে যায় পুরো স্বত্ব। দুদুকের প্রাপ্ত নথি অনুযায়ী শর্তে থাকা  গ্যারান্টি মানি  ছাড়াই টেলিভিশনটি সম্প্রচার স্বত্ব পেয়েছিল। চুক্তি স্বাক্ষরের আগে বোর্ড সভায় বিষয়টি আলোচনা হলেও কোনো মতামত না শুনেই অজ্ঞাত কারণে ওই চুক্তি সম্পন্ন করা হয়। বিসিবির আলোচিত ও লাভজনক এই চুক্তি সম্পর্কিত কমিটিতে ছিলেন তৎকালীন মার্কেটিং ও কমার্শিয়াল কমিটির প্রধান কাজী এনাম আহমেদ। তিনি বিসিবিতে দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া অ্যাসেসমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন মাহবুব উল আনাম, ফিন্যান্স কমিটির প্রধান ছিলেন আফজালুর রহমান সিনহা। ছিলেন বোর্ডের ওয়ার্কিং কমিটির এনায়েত হোসেন সিরাজ। সব মিলিয়ে বিসিবির সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস এই টেলিভিশন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রি প্রক্রিয়ায় ব্যাপকহারে ছিল কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট, যার থেকে বড় অনিয়ম ও দুর্নীতির গন্ধ পাওয়া যায়। 


 লজিস্টিকস অ্যান্ড প্রটোকল খাতে অনিয়ম 

 দুদকের অভিযোগে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী বিসিবির লজিস্টিকস অ্যান্ড প্রটোকল বিভাগে ব্যাপক দুর্নীতি করেছেন শেখ সোহেল ও ইসমাইল হায়দার মল্লিক গং। সে কারণে এ সংক্রান্ত খাতগুলোর 


 আয়-ব্যয়েও দুর্নীতির উৎস খুঁজছে দুদক। এ খাতে বিশাল বাজেটের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত 


পাপন-মল্লিকের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন। জাতীয় দল থেকে শুরু করে বয়সভিত্তিকের আন্তর্জাতিক সফর, খাবার, এয়ার টিকিটসহ নানা খাতের তদারকি করতেন তারা। শুধু তাই নয়, ঘরোয়া টুর্নামেন্টগুলোর ক্ষেত্রেও বড় দায়িত্ব পালন করে এই বিভাগ। প্রতিটি সফরে অন্তত ৩ কোটি টাকা ব্যয় না করলে হিসাবই মেলাতে পারত না লজিস্টিকস বিভাগ। এমনকি বিসিবির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের খাওয়া-দাওয়ার বিল-ভাউচারের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি করেছেন এই বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 


 বোর্ড পরিচালকদের বিলাসিতা 

 পাপনের মতোই বিলাসিতা ও স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে যান বিসিবির অন্য পরিচালকরাও। পূর্বাচলের স্টেডিয়ামের কাজ পাইয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠান পপুলাস থেকে একটা বড় সুবিধা আদায় করে বিসিবি কর্মকর্তাদের একটি অংশ। ২০২৩ সালে বিসিবির সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থিত অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশন  অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশ ক্রিকেট পার্টনারশিপ  চুক্তি হয়। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২০২৪ সালে বিসিবির কয়েকজন পরিচালক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ৯ জন অস্ট্রেলিয়া সফরে যান। পুরো ব্যয় অস্ট্রেলিয়া হাইকমিশনের করার কথা থাকলেও পরবর্তী সময়ে বোর্ডের হিসাবে এ খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। পাপনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুবাদে একাধিক পরিচালককে বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে নানা অনৈতিক সুবিধা দেওয়া ও নেওয়ার প্রমাণ পেয়েছে দুদকের তদন্ত দল। 


 এনএসসির স্টেডিয়ামে বিসিবির অপ্রয়োজনী ব্যয় 

 দেশের সব স্টেডিয়ামের মালিক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি)। কিন্তু এসব স্টেডিয়ামের নির্মাণ, সংস্কার, শোভাবর্ধনের খাতে বছরের পর বছর ব্যাপক অর্থ ব্যয় দেখিয়েছেন পাপনের নেতৃত্বাধীন বোর্ড। দুদকের অনুসন্ধানের আওতায় এই বিষয়টিও এসেছে। কালবেলার অনুসন্ধানে দেখা যায়,  শুধু স্টেডিয়ামের সংস্কারের পেছনে বিসিবি ব্যয় করেছিল ১৪১ কোটি টাকা। যার পুরোটাই অযাচিত ছিল বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।  


 বল কেনায় ৯২ কোটি 

বিসিবির বিভিন্ন টুর্নামেন্ট ও সিরিজের জন্য বিপুল পরিমাণে বল কিনে থাকে। ছোট্ট এই খাতে বড় অনিয়মের তথ্য পেয়েছে দুদক। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১৩ বছরে পাপনের বোর্ড বল কিনতে ব্যয় করেন ৯২ কোটি টাকা। এর মধ্যে আছে কোকাবুরা, ডিউক, এসজি, সিএসহ আরও বিভিন্ন ধরনের বল। সর্বশেষ অস্ট্রেলিয়া হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে আসার সময় তারা কিনেছিল ১২ কোটি টাকার কোকাবুরা বল। দুদক এই বিশাল অনিয়মের বিষয়টি তদন্তের আওতায় এনেছে। 


 পূর্বাচল স্টেডিয়ামে নিয়মবহির্ভূত ব্যয় 

 পূর্বাচল স্টেডিয়াম নির্মাণের শুরুতে হয়েছে বড় অনিয়ম। দুদক এ সংক্রান্ত সবধরনের নথিপত্র চেয়েছে বিসিবির কাছে। পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে ইওআইয়ের সব নথিপত্রও দিতে বলা হয়েছে। তবে অবাক করার বিষয় হচ্ছে, এই স্টেডিয়ামের পরামর্শক হওয়ার আবেদন করেছিল অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, ভারত ও সিঙ্গাপুরের মোট ৫টি প্রতিষ্ঠান। বিসিবি বেছে নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়ান প্রতিষ্ঠান পপুলাসকে। স্টেডিয়ামের পরামর্শ হিসেবে তাদের ফি ধরা হয়েছিল ৭৬ কোটি টাকা। ৮০০ কোটি টাকা বাজেটের এই স্টেডিয়ামের পরামর্শক ফিতে পরিশোধেও হয়েছে অনিয়ম। নিয়ম অনুযায়ী ফি ২ দশমিক ৫ শতাংশ হওয়ার কথা থাকলেও বিসিবি পপুলাসের সঙ্গে চুক্তি করেছিল প্রায় ১০ শতাংশে। পূর্বাচলে একটা ইটের কণা না পড়লেও কাজ শুরুর আগেই ৬০ শতাংশ অর্থ নিয়ে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি কাজের কোনো অগ্রগতি না থাকলেও বাকি অর্থ পেতে জানুয়ারিতে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার মাধ্যমে বিসিবিকে চিঠিও পাঠায় প্রতিষ্ঠানটি। একই সঙ্গে প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে ২ লাখ টাকা মাসিক পারিশ্রমিকে ৩ বছরের চুক্তিতে নিয়োগও দিয়েছে বিসিবি। মাঠ পূর্বাচলে হলেও দীর্ঘদিন ধরে বিসিবিতে বসতে দেখা যায় তাকে। ৪৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই মাঠের ব্যয়ের হিসাব নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন। এই পপুলাস আহমেদাবাদের ১ লাখ ২৫ হাজার দর্শক ধারণের নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়ামের কাজ করেছিল, যেখানে মোট ব্যয় ছিল ৭০০ কোটি রুপি। অথচ পূর্বাচলের স্টেডিয়ামের ব্যয়ের হিসাব করা হয়েছিল প্রতিটি সিট ধরে, যার পুরোটাই অনিয়ম বলে ধারণা করছেন নির্মাণ-সংশ্লিষ্টরা। এ সংক্রান্ত কমিটিতে ছিলেন শেখ সোহেল, মাহবুব উল আনাম, আকরাম খান, ইসমাইল হায়দার মল্লিকরা। পরবর্তী সময়ে দেশের ক্ষমতার পালাবদলে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়ার নির্দেশে স্টেডিয়ামের নির্মাণ কার্যক্রম স্থগিত করেছে বিসিবি। 


 এটা কর্তৃত্ববাদের প্রতিফলন: 

 ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিসিবি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের যে কর্তৃত্ববাদ ছিল এটা তারই একটা প্রতিফলন। দুদক অনুসন্ধান করছে, তখন প্রত্যাশা যদি অযৌক্তিকভাবে এসব ব্যয় নির্ধারণ হয়ে থাকে, তাহলে এটা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়। এসব অনিয়ম জালিয়াতি ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত সবার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি না হয়।