জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের চান্দুরা ডাকবাংলোর সামনে, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক যেন এক জ্বলন্ত মঞ্চে রূপ নিয়েছে—লাখো মানুষের ক্রোধ, আকাঙ্ক্ষা আর অধিকারের দাবি একসঙ্গে মুখরিত হয়েছে। সোমবার দুপুরে, অখণ্ড বিজয়নগর রক্ষার পবিত্র দাবিতে, নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে হামলার তীব্র প্রতিবাদে, বিজয়নগর উপজেলার সর্বস্তরের জনগণ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ সমাবেশে রূপ দিয়েছেন।
আধা ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি ছিল শুধু একটি সমাবেশ নয়, বরং একটি জাগ্রত জনতার হৃদয়ের হুঙ্কার, যেখানে প্রতিটি কণ্ঠস্বর সত্যের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে, আর অধিকারের পক্ষে উচ্চারিত হয়েছে। সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহর অভিযোগ ছিল রক্ত জমানো—তিনি দাবি করেন, ২৪ আগস্ট ২০�২৫-এ নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে, এবং বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানার নির্দেশে তার উপর হামলা চালানো হয়েছে। এই অভিযোগ শুধু একটি ব্যক্তির উপর হামলার গল্প নয়, বরং এটি গণতন্ত্রের উপর আঘাত, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর নির্মম দমন, এবং জনগণের ঐক্যের বিরুদ্ধে একটি সুকৌশলী ষড়যন্ত্রের চিত্র তুলে ধরে। আতাউল্লাহর কণ্ঠে ক্ষোভ আর বেদনার মিশ্রণ স্পষ্ট।
তিনি বলেন, রুমিন ফারহানা বিজয়নগরের চান্দুরা, বুধন্তী ও হরষপুর ইউনিয়নকে কেটে সরাইল-আশুগঞ্জের সঙ্গে যুক্ত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন, যা বিজয়নগরের দশটি ইউনিয়নের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে সরাসরি হুমকি। তিনি আরও জানান, বিগত সরকারের আমলে ২০১৮ সালে সংরক্ষিত নারী আসনের মাধ্যমে এমপি হওয়া রুমিন ফারহানা সেই সময় নানা সুবিধা ভোগ করেছেন, এবং এখন তিনি মিথ্যাচারের মাধ্যমে বিজয়নগরের জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এই অভিযোগে সমাবেশে উপস্থিত জনতার মধ্যে ক্রোধের আগুন যেন আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বক্তারা একযোগে বলেন, রুমিন ফারহানা ও তার সহযোগীরা নির্বাচন কমিশনের শুনানিস্থলকে রণক্ষেত্রে পরিণত করেছেন, গণতন্ত্রের নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে পদদলিত করেছেন।
তাদের দাবি, অখণ্ড বিজয়নগর রক্ষা কোনো দলীয় স্বার্থ নয়, বরং এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণের ন্যায্য অধিকার। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহ, বিজয়নগর উপজেলা প্রধান সমন্বয়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আমিনুল হক চৌধুরী, উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটির সিনিয়র সদস্য রাষ্টু সরকার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রনেতা মিজানুর রহমান, এনসিপি নেত্রী জয়ন্তী বিশ্বাসসহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। তবে এই সমাবেশ শুধু রাজনৈতিক নেতাদের মঞ্চ ছিল না—সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী—সব শ্রেণির মানুষ একত্রিত হয়েছিল এই মঞ্চে, যেন বলতে চায়, বিজয়নগরের অখণ্ডতা তাদের হৃদয়ের ধর্ম। এই বিক্ষোভের প্রতিটি শ্লোগান, প্রতিটি প্ল্যাকার্ড, প্রতিটি কণ্ঠস্বর যেন একটি প্রশ্ন তুলে ধরছিল—গণতন্ত্র কি শুধু কথার ফুলঝুরি, নাকি এটি জনগণের অধিকারের প্রকৃত রক্ষক? রুমিন ফারহানার বিরুদ্ধে অভিযোগের তীর শুধু তার ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ডের দিকে নয়, বরং এটি একটি বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত বহন করে। স্থানীয় নেতারা দাবি করেন, বিজয়নগরের ইউনিয়নগুলো ভেঙে সরাইল-আশুগঞ্জে যুক্ত করার চেষ্টা শুধু ভৌগোলিক সীমানার পরিবর্তন নয়, বরং এটি স্থানীয় জনগণের সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিচিতির উপর আঘাত।
বিজয়নগরের মানুষ তাদের দশটি ইউনিয়নের অখণ্ডতা নিয়ে গর্বিত, এবং এই অখণ্ডতা ভাঙার যে কোনো চেষ্টাকে তারা প্রতিহত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। এই বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে জনগণের একটি স্পষ্ট বার্তা উঠে এসেছে—তারা আর নীরব থাকবে না, তারা আর অধিকার হরণের শিকার হবে না। সমাবেশে উপস্থিত একজন স্থানীয় কৃষক বলেন, “আমরা আমাদের জমি, আমাদের ঘর, আমাদের বিজয়নগরকে ভালোবাসি। কেউ যদি আমাদের এই পরিচিতি কেড়ে নিতে চায়, আমরা রাস্তায় নেমে আসব, আমরা লড়ব।” এই কথাগুলো শুধু একজন কৃষকের কথা নয়, এটি বিজয়নগরের প্রতিটি মানুষের হৃদয়ের ধ্বনি। এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে রুমিন ফারহানার পক্ষ থেকেও প্রতিক্রিয়া এসেছে। তিনি দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনের শুনানিতে তিনি নিজেই হামলার শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি একজন আইনজীবী হিসেবে আমার মতামত পেশ করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে আমার উপর ধাক্কাধাক্কি করা হয়েছে, আমাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। যে বিএনপির জন্য আমি ১৫ বছর লড়াই করেছি, তারাই আজ আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে।” তার এই বক্তব্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজনৈতিক মাঠে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। তবে বিজয়নগরের জনগণের দাবি, এই ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত আক্রমণের বিষয় নয়, বরং এটি গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভের উপর আঘাত। তারা বলেন, নির্বাচন কমিশনের শুনানি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, এবং এই প্রক্রিয়াকে রণক্ষেত্রে পরিণত করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সমাবেশে উপস্থিত নেতারা আরও বলেন, “আমরা সুষ্ঠু নির্বাচন চাই, আমরা গণতন্ত্র চাই, আমরা আমাদের অধিকার চাই। যারা এই অধিকারের পথে বাধা সৃষ্টি করছে, তাদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনতে হবে।” এই বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে বিজয়নগরের জনগণ তাদের ঐক্যের শক্তি দেখিয়েছে। তাদের দাবি একটাই—অখণ্ড বিজয়নগর রক্ষা করা হবে, যে কোনো মূল্যে। এই ঘটনা শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সীমানায় আটকে নেই, এটি দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার উপর একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন। নির্বাচন কমিশন কি এই ঘটনার পর সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ শুনানি নিশ্চিত করতে পারবে? রুমিন ফারহানার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ কি তদন্তের মাধ্যমে সত্যতা প্রমাণ করবে? নাকি এটি আরেকটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের অংশ? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর সময়ই দেবে। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার—বিজয়নগরের জনগণ তাদের অধিকারের জন্য লড়তে প্রস্তুত। তাদের এই বিক্ষোভ শুধু একটি সমাবেশ নয়, এটি একটি জাগরণ, একটি বিপ্লবের পূর্বাভাস। প্রতিটি শ্লোগান, প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি কণ্ঠস্বর যেন বলছে—আমরা বিজয়নগর, আমরা অখণ্ড, আমরা অপরাজিত।