তপ্ত মরুর বুকে অনন্ত প্রশান্তির স্রোতোধারা বইছে হজের এই পবিত্র মৌসুমে। লাখো মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন তাওহিদের ছায়াতলে। ভাষার ব্যবধান ভেঙে মিলিত হয়েছেন এক আত্মিক ঐক্যে। মিনা, আরাফাতসহ সবখানেই আল্লাহর করুণা ও রহমতের বৃষ্টি ঝরছে অবিরাম।
হজ আত্মশুদ্ধির এক মহাসমাবেশ। এ এমন এক মিলনমেলা, যেখানে লাখো মানুষ তাদের গৃহত্যাগ করে ছুটে আসে প্রভুর প্রেমে, রুহের পরিশুদ্ধির আশায়। কেউ হয়তো এসেছেন আফ্রিকার মরু পেরিয়ে, কেউ এসেছেন ইউরোপের বরফঢাকা নগর থেকে। আবার কেউ এসেছেন বাংলাদেশের মতো সবুজ ভূমির দেশ থেকে, তবে সবাই এখানে এসেছেন একটিই পরিচয়ে তারা সবাই মহান প্রভুর বান্দা।
হজ মানে নিজেকে সমর্পণ করা। হজ মানে জীবনের সব অহংকার, আড়ম্বর, বিভেদ আর বৈষম্য দূরে রেখে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা। কাফনের মতো সাদা ইহরামে আবৃত হাজারো প্রাণের সমবেত উচ্চারণ, ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক’ তাদের দুনিয়াবি পরিচয় ভেঙে দেয়। এ ধ্বনি যেন আসমান কাঁপিয়ে তোলে, ফেরেশতারা অবাক বিস্ময়ে নেমে আসেন আর মহান প্রভু বলেন, আমার বান্দারা এসেছে আমার ডাকে সাড়া দিয়ে...।
প্রতি বছর হজ মৌসুমে আরাফাতের ময়দান হয় ইতিহাসের এক মহান সাক্ষী, সেখানে বান্দারা কাঁদে, আল্লাহ শোনেন। বান্দারা ডাকে, আল্লাহ জবাব দেন। এই পবিত্র দিনে মানবজাতি যেন নতুন করে প্রতিজ্ঞা করে, তারা আল্লাহর পথে চলবে, শান্তি, সংহতি ও ন্যায়ের দিশারি হবে।
গতকাল বুধবার মিনা প্রান্তরে অবস্থানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পবিত্র হজের আনুষ্ঠানিকতা। হজ পালনকারীদের জোহরের নামাজের আগে মিনায় পৌঁছানো সুন্নত। মিনায় হাজিরা জোহর, আসর, মাগরিব, এশা ও ফজরের নামাজ আদায় করেছেন। এখানে সারা দিন ও রাত যাপন শেষে রওনা হয়েছেন আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশে। অনেকেই পৌঁছে গেছেন। ইতিমধ্যে আরাফাতের ময়দান মুখরিত হয়ে উঠেছে লাব্বাইক ধ্বনিতে।
প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখের মধ্যে হজের মূল আনুষ্ঠানিকতাগুলো সম্পন্ন করা হয়। এ সময়ের মধ্যে হজযাত্রীরা পাঁচ দিনের বিভিন্ন ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতায় অংশ নেন।
পবিত্র হজের অন্যতম ফরজ আমল হলো ৯ জিলহজ আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা। এবার দিনটি তীব্র গরমের সময় হওয়ায় সৌদি কর্র্তৃপক্ষ আরাফাতের ময়দানে হাজিদের নির্দিষ্ট তাঁবুতে অবস্থানের আহ্বান জানিয়েছে। আরাফাতের দিন লাখ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য সৌদি আরবের হজ ও ওমরাহ মন্ত্রণালয় একাধিক সতর্কতামূলক নির্দেশনা জারি করেছে। ওই নির্দেশনায় আরাফাতের দিনে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত নির্ধারিত তাঁবুতে থাকার জন্য হজযাত্রীদের আহ্বান জানানো হয়। এ সময় হজযাত্রীদের জাবালে রহমত (আরাফাত পর্বত) বা মসজিদে নামিরার উদ্দেশে না আসার জন্যও বিশেষভাবে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
সৌদি প্রেস এজেন্সি মন্ত্রণালয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে জানিয়েছে যে, এ নির্দেশনার উদ্দেশ্য হলো, পবিত্র স্থানগুলোতে তীব্র সূর্যালোকের সরাসরি সংস্পর্শ এবং তাপমাত্রার ক্ষতি থেকে হজযাত্রীদের রক্ষা করা।
সৌদি আরবের ধর্মবিষয়ক প্রেসিডেন্সি গত ২৫ মে ঘোষণা করেছে যে, এ বছর হজের খুতবা প্রদান করবেন বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার শায়খ সালেহ বিন হুমাইদ। সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ এক রাজকীয় ফরমানে তাকে আরাফাতের দিনে খুতবা দেওয়ার জন্য নিয়োগ দিয়েছেন। আজ আরাফাতের ময়দানে স্থানীয় সময় দুপুর সোয়া ১২টায় হজের খুতবা দেবেন তিনি।
হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে জোহর ও আসরের নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন। এরপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত তালবিয়া, তাহমিদ, দোয়া-দরুদ, ইসতেগফার, আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করতে থাকবেন। সূর্যাস্তের পর মাগরিব না পড়েই মুজদালিফায় রওনা হবেন। রাত যতক্ষণই হোক, মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ একসঙ্গে আদায় করবেন। হাজিরা এ রাতে মুজদালিফায় বিশ্রাম নেবেন বা ঘুমাবেন। ফজরের নামাজ পড়ে ফের মিনার উদ্দেশে যাত্রা করবেন। মুজদালিফা থেকে পাথর সংগ্রহ করে সঙ্গে আনবেন। ১০ জিলহজ হাজিরা শুধু বড় শয়তানের স্তম্ভে (জামারাতে উকবা) সাতটি পাথর নিক্ষেপ করবেন। জামারাতে পাথর মারার পর কোরবানির সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে কোরবানি দেবেন। কোরবানি করার পর মাথা মুণ্ডাবেন বা চুল খাটো করবেন। এসব আমল শেষে তাওয়াফ ও তাওয়াফে জিয়ারত করবেন। অবশ্য ভিড় এড়ানোর জন্য এ তাওয়াফ ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিলম্ব করা যাবে।
১১ জিলহজ শয়তানের তিন স্তম্ভে পাথর নিক্ষেপ করবেন। ১২ জিলহজ তিন স্তম্ভে আবার পাথর নিক্ষেপ করবেন। এভাবে পাথর মারার সংখ্যা ১০ জিলহজ সাতটি, ১১ জিলহজ সাতটি করে ২১টি এবং ১২ জিলহজ সাতটি করে ২১টি পাথর মারতে হবে। উল্লেখ্য, ১০ ও ১১ জিলহজ তাওয়াফে জিয়ারত করতে না পারলেও ১২ জিলহজ সূর্যাস্তের আগে অবশ্যই সম্পাদন করতে হবে। ১২ তারিখের পর হাজিরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবেন। এই হলো হজের সার্বিক কার্যক্রম।
আরাফাতে অবস্থানকেই মূলত হজ হিসেবে ধরা হয়। এবার বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রায় ১৬ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ জন এবং স্থানীয় ৪ লাখ মানুষ হজপালন করছেন। হজপালন নির্বিঘœ করতে কড়া নিরাপত্তাসহ নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সৌদি সরকার।
সৌদি আরবের মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববির তত্ত্বাবধানকারী সংস্থার অধীনে ধর্মবিষয়ক বিভাগ এবারের হজের খুতবা ৩৫টি ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছে। আরব নিউজের বরাতে জানা যায়, মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববির পরিচালনা পরিষদের প্রধান শায়খ আবদুর রহমান আস-সুদাইস বলেছেন, ‘দুই পবিত্র মসজিদ থেকে ইসলামের মধ্যপন্থার বার্তা বিশ্বে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ৩৫টি ভাষায় হজের খুতবার অনুবাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
হজের খুতবা আরাফাতের ময়দানে অবস্থিত নামিরা মসজিদ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে। হজের আধ্যাত্মিক শিক্ষা বিস্তৃত পরিসরে পৌঁছে দিতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় খুতবার অনুবাদ সম্প্রচার করা হয়।
হজের খুতবা যেসব ভাষায় অনুবাদ করা হবে তার কয়েকটি হলোÑ বাংলা, ফ্রেঞ্চ, মালয়, উর্দু, ফার্সি, চায়নিজ, তুর্কি, রাশিয়ান, হাউসা, ইংরেজি, সুইডিশ, স্প্যানিশ, সোয়াহিলি, আমহারিক, ইতালিয়ান, পর্তুগিজ, বসনিয়ান, মালয়ালাম, ফিলিপিনো ও জার্মান ইত্যাদি।