রবিবার, ২২ জুন, ২০২৫

ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে বাংলার নদী: ক্ষমতার পালাবদলে কেন বদলায় না তাদের করুণ পরিণতি?


জহির শাহ্

নদীর হাহাকার, জনপদের দীর্ঘশ্বাস: এক নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি বাংলাদেশ

বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে যখন ক্ষমতার পালাবদল হয়, সরকার আসে, সরকার যায়, সময়ের সাথে পাল্টে যায় অনেক দৃশ্যপট। কিন্তু এক অমোঘ, নির্মম সত্য যেন আজও অপরিবর্তিত – দেশের নদ-নদীর ভাগ্য। অবাক করা বিষয়, হাত বদলে চোখের পলকে দখলদাররা ঠিকই পরিবর্তিত হয়, কিন্তু আমাদের প্রাণবন্ত নদীগুলো তাদের গ্রাস থেকে মুক্তি পায় না। ফল? অব্যাহত দখল আর দূষণের বিষে মুমূর্ষু হয়ে একসময় চিরতরে প্রাণ হারায় তারা মানচিত্র থেকে। বিগত কয়েক যুগে এভাবেই কয়েকশ’ নদী তাদের অস্তিত্ব হারিয়েছে। 


আর যা টিকে আছে, তাও দখল-দূষণে কোথাও সংকীর্ণ হয়ে গেছে, আবার কিছু নদী পানিপ্রবাহের গতিপথ হারিয়ে যেন কোনোমতে ধুঁকে ধুঁকে বেঁচে আছে। ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগসহ দেশের অসংখ্য নদী উদ্ধারে দফায় দফায় অভিযান চললেও, সেই কার্যক্রম এখন অনেকটাই স্থবির। এর পেছনের কারণ কী? কারা এর জন্য দায়ী? এই প্রশ্নগুলো আজ লাখো মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে।


বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ: রাজনৈতিক প্রভাবই কি নদীর প্রধান প্রতিবন্ধকতা?
নদী রক্ষায় দেশে একাধিক মন্ত্রণালয় এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) থাকা সত্ত্বেও কেন এর সুরক্ষা অসম্ভব হয়ে পড়ছে? বিশেষজ্ঞরা এর পেছনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন রাজনৈতিক প্রভাবকে। তাদের গভীর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, "এক সরকার গেলে আরেক সরকার আসে। তাতে দখলদার বদলায়। কিন্তু তাতে নদীর ভাগ্য বদলায় না। কারণ আগে যারা দখল করেছে তাদের পথ অনুসরণ করেই নতুনরা একই অপরাধ চালিয়ে যায়। এর পেছনে রাজনৈতিক শক্তি সহায়ক হিসেবে কাজ করে।" এই নির্মম বাস্তবতা নদীরক্ষা কার্যক্রমকে বারবার ব্যর্থতার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, যার ফল ভোগ করছে দেশের কোটি কোটি মানুষ।


দখলদারিত্বের মহোৎসব: ক্ষমতার ছত্রছায়ায় নদীর নিদারুণ সর্বনাশ
বাংলাদেশের নদী দখলের ইতিহাস বড়ই কলঙ্কজনক, আর তা চলে এসেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ছত্রছায়ায়। বিগত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রাণ কর্ণফুলী নদী দখলের মহোৎসবে মেতেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। নদীর বুকে অবৈধ মাছবাজার গড়ে উঠেছিল – যা নদীর প্রতি এক নির্লজ্জ আগ্রাসন। কর্ণফুলী রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা, সেই বন্দর কর্তৃপক্ষও 'ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের' নামে নদী ভরাট করে প্রভাবশালী মহলের হাতে ইজারা দিয়েছে! মিঠাপুকুরের যমুনেশ্বরী নদীতেও সরকারি অনুমতি নিয়েও অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হয়েছে। চাঁদপুরেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় চলেছে নদী দখলের মহাযজ্ঞ। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও, নদী দখলদারদের অপতৎপরতা যেন থামছে না।


তবে, সকল রেকর্ড ভেঙে নদী দখল-দূষণের এক নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে কয়েকটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও উপজেলায় অবস্থিত মেঘনা নদীর শত শত বিঘা জমি অবৈধভাবে দখল করে কিছু কোম্পানী অনেকগুলো বিশাল শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছে। এই দানবীয় শিল্প সাম্রাজ্য গড়তে গিয়ে এসব গ্রুপ বছরের পর বছর ধরে মেঘনা নদীকে গ্রাস করেছে, কিন্তু তাদের প্রভাবশালী অবস্থানের কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই চিত্র দেশজুড়ে এক ভয়াবহ বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়, যেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার দাপটে নদী দখল যেন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরও দখলদার বদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু নতুন করে রাজনৈতিক প্রভাবে নদী দখল অব্যাহত রয়েছে। এ যেন এক চক্রাকার বিষাক্ত খেলা, যার বলি আমাদের পরিবেশ আর ভবিষ্যৎ।


নদীর পাঁচ সংকটের মরণফাঁদ: নীরব ঘাতকের ছোবলে বিলুপ্তির পথে বাংলার জলধারা
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের নদ-নদীগুলো মূলত পাঁচটি প্রধান সংকটে জর্জরিত, যা তাদের দ্রুত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে:

১. প্রবাহ স্বল্পতা: পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে অনেক নদী, মরে যাচ্ছে তাদের গতিশীলতা।
২. দখল: অবৈধ দখলদারিত্বের মাধ্যমে নদীর গতিপথ রুদ্ধ করা হচ্ছে, শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় পড়েছে জলধারা।
৩. দূষণ: অপরিশোধিত শিল্পবর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্য এবং রাসায়নিক পদার্থের মাধ্যমে নদীকে বিষাক্ত করা হচ্ছে, পরিণত হচ্ছে ভাগাড়ে।
৪. বালু-পাথর উত্তোলন: অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলনে নদীর তলদেশ ও পাড় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, যা ভাঙন ও গতিপথ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
৫. ভাঙন: নদীর পাড় ভাঙনও একটি বড় সমস্যা, যা নদীর সীমানা সঙ্কুচিত করছে।
এর বাইরে, ঢাকার চারপাশের চার নদী—বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু এবং শীতলক্ষ্যার দূষণ সীমাহীন। গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন নদ-নদীর অবস্থাও একই রকম। সারা দেশে চলছে দখল-দূষণের এক আগ্রাসী প্রতিযোগিতা। মাঝেমধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও, নানা ফাঁকফোকর আর সীমাবদ্ধতায় তা থমকে যায়।


কমিশনের সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার গল্প: এক অদৃশ্য শক্তির কাছে যেন হার মানছে সবাই!
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ভূমিকাও বারবার প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, কারণ এর চেয়ারম্যান পদে যারা এসেছেন, তারা স্বাধীনভাবে এবং যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। কেউ ব্যর্থ হয়েছেন, আবার কেউ তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছেন।


প্রথম চেয়ারম্যান আতহারুল ইসলাম নদীর পক্ষে থাকলেও সুরক্ষা কার্যক্রমে তেমন সাহসী ভূমিকা নিতে পারেননি। এরপর মুজিবুর রহমান হাওলাদার-এর সময়ে নদী রক্ষা কমিশন কিছুটা সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু তার মেয়াদ শেষে এ এস এম আলী কবীর দায়িত্ব নেওয়ার পর কমিশন অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। তার মৃত্যুর পর মনজুর আহমেদ চৌধুরী নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে যোগ দিয়ে কমিশনকে আবার সক্রিয় করে তোলেন এবং সাহসী ভূমিকা নেন, কিন্তু রহস্যজনকভাবে তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এমন প্রতিকূলতায় যারা দায়িত্বে আসছেন, তারা যেন কাজের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন, এক অদৃশ্য শক্তির কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের ছবি স্পষ্ট হচ্ছে।


পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা: যখন সংখ্যাগুলোই কাঁদে!
পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে নদীর করুণ চিত্র আরও স্পষ্ট হয়, যা প্রতিটি সচেতন নাগরিকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। শুধু ব্যক্তি নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও উন্নয়নের নামে নদীর জায়গা দখল চলছে – এ যেন সর্ষের ভেতর ভূত! শিল্প-কারখানার অপরিশোধনকৃত বর্জ্য, মানুষের পয়ঃবর্জ্য, প্লাস্টিকসহ নানা রকম অপচনশীল দ্রব্য নির্দ্বিধায় নদীতে ফেলে দূষণ করা হচ্ছে, আমাদের জীবনদায়ী জলধারাকে পরিণত করা হচ্ছে বিষাক্ত জলাধারে। অপরিকল্পিত ও অবৈধ বালু উত্তোলন, চাষাবাদ এবং মাছ ধরার জন্য নদীর বুকে বাঁধ দিয়ে এর প্রবাহকে সংকীর্ণ করা হচ্ছে।


প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে শাখা-প্রশাখা ও উপনদী মিলে প্রায় ৭০০ নদী রয়েছে। তবে দেশের শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত অন্তত ২৮টি নদ-নদী দখল আর দূষণের শিকার হয়ে এখন মৃতপ্রায়। ৫৩টি জেলার নদী ও খালের বিভিন্ন অংশ দখল করেছে ১০ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের মতে, নদী দখলদারদের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি—প্রায় ৪৭ হাজার। এর মধ্যে শুধু ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জেই ১৯৮টি দূষণকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে; ঢাকার ১২০টি এবং নারায়ণগঞ্জের ৭৪টি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিশনের এক কর্মকর্তা জানান, দেশের অনেক স্থানে দখলদাররা নানা রকম প্রভাব খাটিয়ে নদী ও খালের তীরবর্তী স্থান দখলে নিয়ে অনেকে বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এমনকি নদীর তীরবর্তী স্থানে অবৈধ হাটবাজারও বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ছাড়াও এসবের সাথে স্থানীয় ভূমি অফিসের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত – যা এক ভয়াবহ সিন্ডিকেটের দিকে ইঙ্গিত করে।


কর্মকর্তাদের কণ্ঠস্বর: দায়বদ্ধতা ও আইনের প্রয়োগের কঠিন প্রশ্ন
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নদী রক্ষা কমিশনের একজন বলেন,   (২১ জুন, ২০২৫) নয়া "নদী দখল দূষণে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে ডিসিদের এ বিষয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।" তার এই বক্তব্য আশার সঞ্চার করলেও, বাস্তব পরিস্থিতি এবং অতীতের অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলে।


নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক কর্মকর্তা আরও বলেন, "নদী হলো রাষ্ট্রের সম্পদ। কিন্তু এসব রক্ষায় আইনের যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তারাও এ জন্য দায়ী। তাই যারা চেয়ারে বসে নদী রক্ষার দায়িত্বে আছে তাদের বিরুদ্ধেও মামলা হওয়া উচিত।" তিনি এনআরসিসি'র কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তার অভিযোগ, সিএস ম্যাপের অজুহাতে ৩৭ হাজারেরও বেশি দখলদারের তথ্য মুছে দিয়ে তাদের 'দায়মুক্তি' দেওয়া হয়েছে। উনার এই বিস্ফোরক মন্তব্য যদি সত্যি হয়, তবে তা দেশের নদী রক্ষার প্রচেষ্টায় এক ভয়াবহ প্রহসনের চিত্র তুলে ধরে। তার আশঙ্কা, "কমিশন এমন ভুল পদক্ষেপ নিয়ে এগোতে থাকলে অল্প দিনের মাথায় দেশের বড় বড় নদীও মানচিত্র থেকে বিলীন হয়ে যাবে।"


চূড়ান্ত বার্তা: নদীর কান্না কি কেবলই নীরব আর্তনাদ হয়ে ইতিহাসে স্থান পাবে?
নদীর এই করুণ পরিণতি কেবল পরিবেশগত সংকট নয়, এটি আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং অগণিত মানুষের জীবন-জীবিকার প্রতি এক বিশাল হুমকি। যদি নদী রক্ষায় সরকার, প্রশাসন, এবং সর্বোপরি নাগরিক সমাজ সম্মিলিতভাবে কাজ না করে, তাহলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বইয়ের পাতায় খুঁজতে হবে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, কিংবা কর্ণফুলীর নাম।
নদীর ভাগ্য পরিবর্তন করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের কঠোর, নিরপেক্ষ এবং আপসহীন প্রয়োগ, পাশাপাশি সকল স্তরের মানুষের মধ্যে গভীর সচেতনতা ও দায়বদ্ধতা। কোনো নির্দিষ্ট দল বা গোষ্ঠীকে অভিযুক্ত না করে, বরং নদী রক্ষার এই জাতীয় সংকটে প্রতিটি নাগরিকের অংশগ্রহণ জরুরি। আজ যদি আমরা সচেতন না হই, তাহলে হয়তো একদিন বিশুদ্ধ পানির জন্য, বেঁচে থাকার জন্য আমাদেরই হাহাকার করতে হবে।


আসুন, আমরা নদীর জীবন ফিরিয়ে আনি। কারণ নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে, মানুষ বাঁচবে। এই একতাবদ্ধ প্রয়াসই পারে আমাদের নদীগুলোকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে।

দুরন্তবিডি কথা বলে, দেশ ও মানুষের জন্য