শুক্রবার, ২০ জুন, ২০২৫

ক্ষমতার দাপটে রক্তাক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর


ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জহির শাহ্ 

জমি নয়, ন্যায়বিচার চায় কুলিকুন্ডা 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ১৬ জুন ২০২৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার কুলিকুন্ডা গ্রামে দুই শতক জমির মালিকানা নিয়ে চরম উত্তেজনা শেষ পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়। এই ঘটনায় নাসিরনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. খায়রুল আলমসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় বিএনপি সমর্থক মো. এরশাদ মিয়া এবং আওয়ামী লীগের সাবেক ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসার মিয়ার মধ্যে এই বিরোধ এখন রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক মহলে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।


ঘটনাস্থল: কুলিকুন্ডা, ৪ নম্বর ওয়ার্ডের রণক্ষেত্র

কুলিকুন্ডা গ্রামের ৪ নম্বর ওয়ার্ডে এই জমি নিয়ে দীর্ঘদিনের বিরোধের সূত্রপাত। ভুক্তভোগী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন বিএনপি সমর্থক মো. এরশাদ মিয়া। অন্যদিকে, অভিযোগের তীর স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাবেক ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক মো. কাউসার মিয়ার দিকে।


ভুক্তভোগীর আকুতি: "শান্তিতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না, আমি আদালতের শরণাপন্ন হয়েছি"

বিএনপির সমর্থক মো. এরশাদ মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, "আমার বাড়ির লাগোয়া দুই শতক জায়গা জোরপূর্বক দখলের চেষ্টা চলছিল। আমি সালিসি সভায় গিয়েছি, শেষে আদালতেও গেছি। এতকিছুর পরও আমাকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না।" তিনি আরও অভিযোগ করেন, সালিসি সভার সিদ্ধান্তও অমান্য করে তার বাড়িতে হামলা চালানো হয়েছে।


কাউসার মিয়ার বিরুদ্ধে স্থানীয়দের ক্ষোভ: "আওয়ামী লীগের ক্ষমতা শেষ হলেও দাপট শেষ হয়নি"

মো. কাউসার মিয়া বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা হলেও, স্থানীয়দের অভিযোগ, তিনি এখনো বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে পূর্বেও দলীয় প্রভাব খাটিয়ে একাধিক জমি নিয়ে বিরোধে জড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন স্থানীয় দোকানদার জানান, "উনি (কাউসার) আগেও এরকম কিছুর সাথে জড়িত ছিলেন। দলীয় পরিচয় দিয়ে যা ইচ্ছে তাই করেন। এখন আওয়ামী লীগ সরকারে নেই, তবুও আগের মতো চালিয়ে যাচ্ছেন।" এই মন্তব্যে স্থানীয়দের মধ্যে কাউসার মিয়ার প্রভাব ও অতীত অপকর্ম নিয়ে জমে থাকা ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।


১৬ জুন সকাল ১০:৩০ — সংঘর্ষের ভয়াবহ সূচনা

গত ১৬ জুন, সোমবার সকাল ১০টার দিকে কাউসার মিয়া তার সমর্থকদের নিয়ে এরশাদ মিয়ার বাড়ির সামনে উপস্থিত হন। অভিযোগ রয়েছে, তারা বাঁশ, রড ও দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এরশাদের বাড়িতে হামলা চালায়। এরশাদের লোকজন প্রতিরোধ গড়ে তুললে আধঘন্টার মধ্যেই ভয়াবহ সংঘর্ষ শুরু হয়, যা পুরো গ্রামকে রণক্ষেত্রে পরিণত করে।


পুলিশের হস্তক্ষেপে রক্ষা, আহত স্বয়ং ওসি

সংঘর্ষের খবর পেয়ে নাসিরনগর থানার ওসি মো. খায়রুল আলম দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। সংঘর্ষ থামাতে গিয়ে তিনি নিজেও আহত হন। পরবর্তীতে অতিরিক্ত পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি শান্ত করে।


আহতদের তালিকা: প্রায় ২০ জন হাসপাতালে

এই সংঘর্ষে উভয় পক্ষের অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন। এরশাদ মিয়ার পক্ষের ১২ জন, কাউসার মিয়ার পক্ষের ৬ জন এবং পুলিশ বাহিনীর দুই সদস্য আহতদের তালিকায় রয়েছেন। আহতদের মধ্যে ওসি খায়রুল আলমও অন্তর্ভুক্ত। আহতদেরকে নাসিরনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।


রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ভাঙা ক্ষমতার ছায়াতলে বৈষম্য?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ক্ষমতার ভারসাম্যে পরিবর্তন এলেও, গ্রামীণ রাজনীতিতে পুরনো পরিচয়ে ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রবণতা এখনো অনেক এলাকায় বিদ্যমান। কুলিকুন্ডার এই সংঘর্ষ তারই একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত, যেখানে একজন ভুক্তভোগী ন্যায়বিচারের জন্য আদালতের দ্বারস্থ হয়েও ক্ষমতার ছায়া থেকে নির্যাতন বন্ধ হয়নি। এটি স্পষ্ট করে যে, ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের অনৈতিক প্রভাব বলবৎ রাখতে মরিয়া।


পুলিশের ভূমিকা প্রশংসনীয় : 

নাসিরনগর থানার ওসি খায়রুল আলম ঘটনার বিষয়ে বলেন, "এটা জমি সংক্রান্ত দীর্ঘদিনের বিরোধ। পুলিশ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেছে। আমরা ঘটনার তদন্ত করছি এবং আইন অনুযায়ী কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।" তার এই বক্তব্য একদিকে যেমন পুলিশের ভূমিকার নিরপেক্ষতা দাবি করে, তেমনি নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশরা যে জনগণকে নিরাপত্তা প্রদান করে তার চাক্ষুষ প্রমাণ সত্যিই প্রশংসনীয়। 


শেষ কথা: রাজনীতি নয়, ন্যায়বিচার চাই

কুলিকুন্ডার এই ঘটনা একটি বড় শিক্ষা দেয়: ক্ষমতা আসতে পারে, যেতে পারে – কিন্তু ন্যায়বিচার চিরস্থায়ী হওয়া উচিত। এই সংঘর্ষ শুধু একটি জমির বিরোধ নয়, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার এবং স্থানীয় পর্যায়ে আইনের শাসনের প্রতি অশ্রদ্ধার এক করুণ চিত্র। প্রশাসন, রাজনীতি এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টাতেই কেবল শান্তি ও সুবিচার নিশ্চিত করা সম্ভব। কুলিকুন্ডার জনগণ এখন জমি নয়, শুধুমাত্র ন্যায়বিচার চায়।