প্রযুক্তি ও নীতি বিশ্লেষক
ডিজিটাল পার্লামেন্ট সামিট ২০২৫
লুসাকা, জাম্বিয়া—প্রযুক্তি ও রাজনীতির যুগলবন্দীতে সারা বিশ্ব যখন দ্বিধা ও দ্বন্দ্বে নিমগ্ন, তখন আফ্রিকায় ঘটলো এক ঐতিহাসিক শুদ্ধি-জাগরণ—৯ থেকে ১১ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত আয়োজিত Africa Digital Parliamentary Summit যেন আধুনিক গণতন্ত্রের এক নবযুগের উদ্বোধনী রণডঙ্কা।
৫৪টি দেশের শত শত সংসদ সদস্য, প্রযুক্তি নীতিনির্ধারক, মানবাধিকার কর্মী, AI বিশেষজ্ঞ, ডেটা সায়েন্টিস্ট, টেলিকম উদ্যোক্তা ও শিক্ষাবিদরা একত্র হয়ে শুধুমাত্র ভবিষ্যতের কথা বলেননি—তারা ভবিষ্যতকে নকশা করেছেন “The Lusaka Declaration” নামে এক যুগান্তকারী ঘোষণাপত্রে, যেখানে ব্লকচেইন-ভিত্তিক ভোটার সিস্টেম, AI-আশ্রিত নীতিনির্ধারণ, ডেটা সার্বভৌমত্ব এবং সাইবার নিরাপত্তাকে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
এই সম্মেলনের প্রতিটি মুহূর্তে উচ্চারিত হয়েছে এমন প্রশ্ন—“প্রযুক্তি কাদের সেবা করবে?” “গণতন্ত্র কি প্রযুক্তির দ্বারা পরিশীলিত হবে, না প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে রাজনৈতিক ছলচাতুরির জন্য?”—এই সভায় আলোচিত হয় যে, AI যদি নিয়ন্ত্রিত না হয়, তবে সেটি পরিণত হতে পারে একধরনের অদৃশ্য ‘নতুন উপনিবেশ’-এ, যেখানে ডেটা হবে অস্ত্র, অ্যালগরিদম হবে নিয়ন্ত্রক, আর জনগণ হয়ে যাবে পণ্য। উত্থাপিত হয় বাস্তব প্রমাণ—কেনিয়ার এক প্রত্যন্ত গ্রামে ব্লকচেইন ভোটিং ব্যবস্থা দূর করেছে ব্যালট জালিয়াতি, জাম্বিয়ার পাহাড়ি অঞ্চলে AI ডায়াগনস্টিক বাঁচিয়েছে গর্ভবতী মায়ের জীবন, নাইজেরিয়ায় স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং প্রশিক্ষণ পাচ্ছে হাজার হাজার তরুণ, যাদের হাতেই গড়ে উঠছে টেক-স্টার্টআপ সাম্রাজ্য। এই প্রতিটি উদাহরণ যেন আফ্রিকান সম্ভাবনার এক নবজাগরণ, যেখানে প্রযুক্তি গণতন্ত্রের হাতিয়ার। কিন্তু এই জাগরণ শুধু আফ্রিকার নয়—এটি এক বৈশ্বিক বার্তা, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো উদীয়মান গণতান্ত্রিক দেশের জন্য। আজ বাংলাদেশ যদি চায় একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও নিরাপদ ডিজিটাল শাসনব্যবস্থা, তবে সময় এসেছে জাতীয় সংসদে “ডিজিটাল গণতন্ত্র ও প্রযুক্তি-সুরক্ষা আইন ২০২৫” প্রণয়নের, যেখানে প্রতিটি এমপি হবেন AI-সচেতন, প্রতিটি সরকারি নথি হবে ব্লকচেইনভিত্তিক, প্রতিটি গ্রাম হবে ডিজিটাল সেন্টার সমৃদ্ধ এবং প্রতিটি নাগরিক হবেন টেক-সক্ষম।
সম্মেলনের নেতৃবৃন্দ—প্যান-আফ্রিকান পার্লামেন্টের সভাপতি ফরচুন চারুম্বিরা ও GSMA মহাসচিব ম্যাটস গ্রানরিড, ঘোষণা করেন যে ২০৩০ সালের মধ্যে আফ্রিকা গড়ে তুলবে ১৮০ বিলিয়ন ডলারের একটি ইনক্লুসিভ ডিজিটাল ইকোনমি, যা কেবল অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতীক নয়, বরং এক নতুন সামাজিক চুক্তি, যেখানে প্রযুক্তি হবে নৈতিকতার বাহক, এবং আইন হবে মানবাধিকারের সুরক্ষা-বর্ম। বাংলাদেশের কল্পনায় যদি উঠে আসে এমন এক দৃশ্য—ঢাকার এক সরকারি অফিসে বসে এক আমলা AI বিশ্লেষণে নীতি তৈরি করছেন, রাজশাহীতে এক কিশোরী VR-এর মাধ্যমে শিখছে জেনেটিক কোডিং, বরিশালের এক সাংবাদিক ডিপফেক ভিডিও শনাক্ত করে উন্মোচন করছেন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র—তবে বুঝে নিতে হবে, লুসাকা সম্মেলন কেবল আফ্রিকার নয়, এটি আমাদেরও ভবিষ্যতের রূপরেখা।
এই সামিট শিক্ষা দেয়, প্রযুক্তিকে আর কাঁচা হাতে ছেড়ে দিলে চলবে না; এটি হতে হবে জনগণের হাতের দস্তানা, যেখানে নেতৃত্ব থাকবে জনস্বার্থে, নীতি হবে জবাবদিহিতার, আর প্রযুক্তি হবে এক সভ্য শাসনের যন্ত্রণা নয়, বরং আলোর উৎস। অতএব, বাংলাদেশ আজ যদি প্রযুক্তির রথে চড়ে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু করতে চায়, তবে লুসাকার সেই আলো আমাদের পথ দেখাতে প্রস্তুত—প্রশ্ন একটাই: আমরা কি সেই আলো গ্রহণে প্রস্তুত?