হবিগঞ্জের বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ড।
জাতীয় প্রতিবেদক :
বৈশ্বিক অস্থিরতা, আমদানি নির্ভরতা ও অভ্যন্তরীণ মজুদের সীমাবদ্ধতায় জ্বালানি ঝুঁকিতে পড়েছে দেশ। দেশীয় কূপগুলোতেও সঞ্চিত গ্যাসের মজুত ফুরিয়ে আসছে। ফলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ ক্রমেই বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানির এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি বাংলাদেশ। এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে বিদ্যুৎ উৎপাদন, পরিবহন, কৃষি এবং শিল্প খাত মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হতে পারে।
--------------------------------------------------------------
বর্তমান প্রেক্ষাপটে জ্বালানি নিরাপত্তা শুধু অর্থনৈতিক নয়, একটি কৌশলগত ও জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় হয়ে উঠেছে। সময়মতো উদ্যোগ না নিলে ভবিষ্যতে এর ফল হতে পারে ভয়াবহ। তাই এখনই জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন—না হলে চলমান সংকটকে ভবিষ্যতের বিপর্যয়ে রূপ নিতে পারে৷
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমদানি নির্ভর ও অস্থায়ী মজুত দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে চরম ঝুঁকিতে ফেলছে। হঠাৎ আমদানি ব্যাহত হলে কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো দেশে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
“আগাম পদক্ষেপ না নিলে বড় রকমের বিপর্যয় নেমে আসবে।”
অধ্যাপক ড. ম. তামিম, জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা এবং হরমুজ প্রণালির অস্থিরতা বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহে অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। বাংলাদেশ যেহেতু আমদানিনির্ভর, তাই এসব বৈশ্বিক সংকটে সরাসরি প্রভাব ফেলবে দেশের তেল ও এলএনজি সরবরাহে।
এছাড়া ব্যাংকিং খাতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, এলসি (ঋণপত্র) জটিলতা ও বাণিজ্য নিষ্ক্রিয়তাও তেল-গ্যাস আমদানিকে বিলম্বিত করছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
বর্তমানে দেশের মোট গ্যাস সরবরাহের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এলএনজি আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ এলএনজি আমদানিতে ব্যাপক সমস্যায় পড়বে, যার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্পখাতে।
সরকারের কিছু উদ্যোগ
সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে, যা আগামী নভেম্বর পর্যন্ত চলবে। এছাড়া, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহারে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়াতে ২০৩০ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২০ শতাংশ পুনর্নবীকরণযোগ্য (সেসব উৎস যা নিঃশেষ হওয়ার ভয় ছাড়াই পুনরায় ব্যবহার করা যায়। এই মধ্যে রয়েছে সূর্য, বাতাস, জল, বায়োমাস এবং ভূ-তাপীয় শক্তি। এগুলো পরিবেশবান্ধব।) উৎস থেকে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, জ্বালানি সংকট মোকাবিলায় শুধু তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ভূতত্ত্ববিদেরা দেশেীয় গ্যাসকূপ থেকে উত্তোলনের তাগিদ দিলেও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের তাতে গুরুত্ব দেয়নি। উল্টো উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানিতে আরও বেশি ঝুঁকে পড়েছে।
“স্বল্প মেয়াদে সংকট মোকাবিলায় সরকার এলএনজির দিকে ঝুঁকেছে। অথচ থ্রি-ডি সিসমিক সার্ভে না করায় ভবিষ্যতের জন্য জ্বালানি নিশ্চয়তা হুমকির মুখে”
গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন, গবেষণা পরিচালক; সিপিডি
তারা বলছেন, দেশে কৌশলগত মজুদ গড়ে তোলা, নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধানে গতি আনা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানো ছাড়া এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়।
এদিকে দেশের সবচেয়ে বড় গ্যাসক্ষেত্র সিলেটের বিবিয়ানায় দ্রুত মজুত ফুরিয়ে আসছে। বর্তমানে কূপটিতে মজুতের একেবারে শেষ দিকের গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। নতুন অনুসন্ধান কূপগুলোতে গ্যাস না পাওয়া গেলে সামনে ভয়াবহ সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান 'হাইড্রোকার্বন ইউনিট' এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিবিয়ানায় প্রমাণিত ও সম্ভাব্য মজুতের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩২১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ঘনফুট (বিসিএফ)। এর মধ্যে ৪ হাজার ৫৩১ বিসিএফ এরই মধ্যে উত্তোলন হয়ে গেছে। ফলে অবশিষ্ট মজুত রয়েছে মাত্র ৭৮৯ দশমিক ৭ বিসিএফ। বর্তমানে তা আরও কমে এসেছে।
বিবিয়ানা গ্যাস ক্ষেত্র থেকে দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে খনিটি দেশের মোট উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক জোগান দিয়ে এসেছে। কিন্তু মজুদ ফুরিয়ে আসলে এক কঠিন বিপদের মুখোমুখি হতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে দেশের বিদ্যুৎ, পরিবহন খাত ও শিল্পকারখানা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়বে।
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ১০০টি নতুন কূপ খননের উদ্যোগ নিলেও প্রকল্পের দৃশ্যমান কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া গভীর সমুদ্র থেকেও গ্যাস উত্তোলনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। তবে প্রকল্পের কাজ ধীরগতিতে চলছে।
হাতে নেওয়া নতুন প্রকল্পগুলোতে পরীক্ষা নীরিক্ষা, সম্ভব্যতা যাচাই, গ্যাসের মজুদ নির্ণয় করা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। একেকটি কূূপে ৩ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়।
এছাড়া বিশ্ববাজারে ডলারের দরে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দেশে বৈদেশিক মূ্দ্রার রিজার্ভ ঘাটতি থাকায় সবসময় প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। তারপরও নানা সংকটের মধ্যেও জ্বালানি সরবরাহ ঠিক রাখতে বিশেষভাবে কাজ করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিরবচ্ছিন্ন, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই জ্বালানি প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে জ্বালানি ন্যায়বিচার নীতি গ্রহণ করা জরুরি।
ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক রাইসুল সৌরভ বলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রধানত গ্যাস ও কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। দেশে বর্তমান গ্যাসের মজুদ একই সঙ্গে শিল্পায়ন ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে আমাদের বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে কয়লা, তেল ও গ্যাস আমদানির উপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হতে হয়েছে।
‘আমাদের মজুদ ফুরিয়ে যাচ্ছে তা ঠিক। তবে আগাম পদক্ষেপ না নিলে বড় রকমের বিপর্যয় নেমে আসবে’ বলে মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম. তামিম। তিনি বলেন, ‘এখনই বিকল্প উৎসের সন্ধান ও অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ নিতে হবে।’
গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে এই খাতে লুটপাট, অপচয় ও দুর্নীতি বেশি হয়েছে। বর্তমান সরকারের সময় নীতি নির্ধারণেও দুর্বলতা দেখা গেছে। স্বল্প মেয়াদে সংকট মোকাবিলায় সরকার এলএনজির দিকে ঝুঁকেছে। অথচ থ্রি-ডি সিসমিক সার্ভে না করায় ভবিষ্যতের জন্য জ্বালানি নিশ্চয়তা হুমকির মুখে।’