Wednesday, 13 August 2025

পুরান ঢাকার চানখারপুল হত্যাকাণ্ড : পুলিশের পোশাক পড়া লোকদের হিন্দি বলতে শোনেন সাক্ষী


আইন-আদালত :
গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বুধবার তৃতীয় দিনের মত সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়।



এদিন সাক্ষ্য দেন চানখারপুলে গুলিতে শহীদ ইসমামুল হকের বড় ভাই মো. মহিবুল হক (২১), শহীদ মোহাম্মদ ইয়াকুবের মা রহিমা বেগম (৫৪) ও ইয়াকুবের প্রতিবেশী চাচা শহীদ আহম্মেদ (৪০)। এর মধ্যে সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ জবানবন্দিতে বলেন, ঘটনার দিন চানখারপুল মোড়ের উল্টোপাশে পুলিশের পোশাক পরিহিত কয়েকজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনেন তিনি। 



সাক্ষী বলেন, ‘৫ আগস্ট পর্যন্ত আমি, আমার ভাতিজা ইয়াকুব, ছেলে সালমান, এলাকার রাসেল, সুমন, সোহেলসহ আরো অনেকে সকাল ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত গণভবনের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। আমরা চানখারপুল এলাকায় পৌঁছালে সেখানে হাজার হাজার লোক চারদিক থেকে জড়ো হচ্ছিল। তখন দেখলাম চানখারপুল মোড়ের উল্টো পাশে অনেক পুলিশ ছিল। পুলিশের পোশাক পরিহিত লোকদের হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শুনি।’ 



সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ বলেন, ‘পুলিশ বাধা দিয়ে আমাদের লক্ষ্য করে ফাঁকা গুলি করে। আমরা যে যার মত ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আবার আমরা সামনে যাওয়ার চেষ্টা করি তখন পুলিশ আমাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। আমার পাশের একজনের পায়ে গুলি লাগে। তাকে আমি সরাচ্ছিলাম। তখন আমাকে একজন বলে ভাতিজা ইয়াকুবের গায়ে গুলি লেগেছে। আমি ঐ ছেলেকে আরেকজনের কাছে রেখে আমার ভাতিজার কাছে যাই। আরো দুইজনসহ ভাতিজাকে অটোরিকশায় করে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন যে, ইয়াকুব মারা গেছে।’ 



সাক্ষী শহীদ আহম্মেদ বলেন, ‘কারা গুলি করেছে তা আমি পরে জেনেছি।’ ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী গুলির নির্দেশ দিয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, মো. ইমরুল (পুলিশ সদস্য) পরিদর্শক আরশাদের উপস্থিতিতে কনস্টেবল সুজন, নাসিরুল, ইমাজ গুলি করেছিল। আমি অপরাধীদের বিচার চাই।’



নিহত ইয়াকুবের মা রহিমা আক্তার জবানবন্দিতে বলেন, ইয়াকুব আন্দোলনে গিয়েছিল। নিউমার্কেটের একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান ছিল ইয়াকুব। ছেলে গোপনে ছাত্র আন্দোলনে যেত। আমি তার দেখা না পেয়ে জিজ্ঞাসা করতাম তুমি কোথায় যাও? কিন্তু সে কিছুই বলতো না।



৫ আগস্ট ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাক্ষী বলেন, চানখারপুল নাজিমুদ্দিন রোডে আন্দোলনে গিয়ে ইয়াকুব গুলিবিদ্ধ হয়। গুলি লাগার বিষয়ে শুনে আমি চিৎকার করে বাসা থেকে বের হয়ে গলিতে যাই। মহল্লার লোকজন আমাকে যেতে দেয়নি। আমাকে জানায় আমার ছেলে সুস্থ আছে। তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি শুরু করলে আমার সন্দেহ হয় আমার ছেলের কিছু হয়েছে। বেলা ২টার দিকে দেখি আমার ছেলের লাশ খাটিয়ায় করে গলির ভিতর নিয়ে আসে।



সাক্ষী রহিমা বলেন, ‘ছেলের শরীর থেকে তখনও খাটিয়া বেয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল। তারপর কাপড় সরিয়ে দেখি পেটে গুলি লেগে পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেছে। ভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে, রক্ত পড়া থামছে না।’



তিনি বলেন, ‘আমি পরবর্তীতে টিভি নিউজ, ভিডিও এবং বিভিন্ন মাধ্যমে দেখেছি যারা গুলি করেছে তারা ছাপা কাপড়ের পোশাক পরিহিত ছিল। পুলিশের গুলিতে আমার ছেলে পড়ে যায়। প্রতিবেশী শহীদ এই দৃশ্য তার মোবাইলে ধারণ করেছিল। আমি তা টিভি নিউজে দেখেছি।’ 



রহিমা বেগম বলেন, ‘যারা আমার ছেলের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিল, যারা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের বিচার চাই।’ তিনি ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ যারা গুলির নির্দেশদাতা এবং যারা এই আদেশ দিয়েছে তাদের সকলের বিচারের আরজি জানান। জবানবন্দি শেষে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা তাদের জেরা করেন। আদালত পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ২০ আগস্ট দিন ধার্য করে। 



এর আগে গত সোমবার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরুর দিনে সাক্ষ্য দেন চারখারপুলে গুলিতে নিহত শহীদ শাহরিয়ার খান আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ। গত মঙ্গলবার সাক্ষ্য দেন পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের একটি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক আঞ্জুয়ারা ইয়াসমিন এবং চানখারপুলে গুলিতে শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ মোস্তাকিমের বাবা শেখ জামাল হাসান। এ মামলায় ৮ আসামির মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন আরশাদ, সুজন, ইমন ও নাসিরুল।



গত বছরের ৫ আগস্ট চানখারপুলে গুলিতে নিহতরা হলেন, শহীদ শাহরিয়ার খান আনাস, শহীদ শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, শহীদ মোহাম্মদ ইয়াকুব, শহীদ মো. রাকিব হাওলাদার, শহীদ মো. ইসমামুল হক ও শহীদ মানিক মিয়া।



গণঅভ্যুত্থানের সময় সাভারের আশুলিয়ায় ৬ তরুণকে গুলি করে হত্যার পর লাশ পোড়ানোর অভিযোগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় অভিযোগ গঠন সংক্রান্ত আদেশ হবে আগামী ২১ আগস্ট। অভিযোগ গঠনের পক্ষে প্রসিকিউশনের এবং অব্যাহতি চেয়ে আসামিদের আইনজীবীদের শুনানি নিয়ে আজ বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল- ২ এ তারিখ ধার্য করে। গত ৭ আগস্ট প্রসিকিউশন পক্ষে শুনানি হয়। বুধবার আসামিপক্ষে অব্যাহতির আবেদন চেয়ে শুনানি হয়। 



এ মামলায় ১৬ আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা ৮ জনকে গতকাল ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়। তারা হলেন সাভার সার্কেলের সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. শাহিদুল ইসলাম, ঢাকা জেলার সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবদুল্লাহিল কাফী, ঢাকা জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) উত্তরের সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন, আশুলিয়া থানার সাবেক উপ- পরিদর্শক (এসআই) আবদুল মালেক, আরাফাত উদ্দীন, এএসআই কামরুল হাসান, শেখ আবজালুল হক এবং সাবেক কনস্টেবল মুকুল চোকদার। স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইফুল ইসলামসহ আরও ৮ আসামি এখনো পলাতক।



মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিহত হন এবং একজন গুরুতর আহত হন। নিহত ৫ জনের লাশ এবং আহত ব্যক্তিকে পুলিশ ভ্যানে তুলে পেট্রোল ছিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়। নিহত ছয়জন হলেন, সাজ্জাদ হোসেন সজল, আস সাবুর, তানজীল মাহমুদ সুজয়, বায়েজিদ বোস্তামি ও আবুল হোসেন। একজনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি।