ইমরুল সুমন :
শেখ মুজিবের নয়, বইয়ের লেখা তার কলেজ বন্ধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কৃষ্ণনগরের থানারকান্দির এ.কে (আবুল খায়ের) রফিকুল হোসেন খায়ের মিয়ার
বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এর "অসমাপ্ত আত্মজীবনী" নিয়ে তোলপাড় সারা দেশ। দেশের জনপ্রিয় টিভি মিডিয়া 'চ্যানেল ২৪' নিউজ করেছে এই বইটি তৈরী করেছেন বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারী ও তার ১২৩ সদস্যের দল। এসবি'র প্রধান থাকার সময় জাবেদ পাটোয়ারী এ কাজ করেন। এর পুরস্কার হিসেবে তিনি পরে পুলিশের আইজিপি হন। বই তৈরী করা দলের সবাইকে রাজধানীর ধানমন্ডি, বসুন্ধরা, উত্তরা, পূর্বাচলে প্লট দেয়ার পাশাপাশি ১ কোটি টাকা করে আর্থিক পুরস্কার দেয়া হয়। এই বিষয়টি দেখভাল করেন শেখ হাসিনার বানিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এমপি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবী করেছিলেন তার বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ৪টি খাতা বা ডাইরির লেখা থেকে এই বইটি তৈরী করা হয়েছে। এদিকে শেখ হাসিনার এই কথাটিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবী করেছেন শেখ মুজিবুর রহমানের বাল্যবন্ধু ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের থানারকান্দির উত্তর লক্ষ্ণীপুর গ্রামের পীরবাড়ির সন্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-২ এ.কে (আবুল খায়ের) রফিকুল হোসেন খায়ের মিয়ার সেঝো ছেলে আবুল খায়ের দেলওয়ার হোসেন দিপু। কানাডা থেকে ফোন করে তিনি বলেন, 'আমার বাবার মৃত্যুর পর উনার লেখা ৪টি খাতা আমার বড় ভাই রাশেদুল হোসেন তাঁর কাছে রাখেন। উনি আমেরিকা থেকে এসে ১ বছর বাংলাদেশে থাকেন। উনার স্ত্রী গুলশান হোসেন ছিলেন শেখ হাসিনার ইডেন কলেজের বান্ধবী। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, খাতা ৪টি আমার বড় ভাই শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন। সে সময় আমি কানাডা চলে এসেছি। খাতাগুলো আমার আব্বাকে জেলখানায় আমি ও আমার মা জোবেদা খাতুন গিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। সঙ্গে কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা কর্মীও ছিল আমাদের সঙ্গে। আমার আব্বা ১৯৫৪ সালে নবীনগর থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। আইয়ুব খান বিরোধী আন্দোলনের গ্রেফতার হয়ে আব্বা ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারগারে বন্দী ছিলেন। সে সময় ৪টি চারকোনা খাতা আমরা আব্বাকে জেলখানায় দিয়ে আসি। খাতাগুলো ছিল ব্রাউন কালারের পাথরের রঙের। মাঝখানে ফিরোজা নীল রঙের কাপড় দিয়ে বাউন্ডিং করা। রুল করা খাতাগুলো আমরা জেলারের কাছে তুলে দেই। উনি সেগুলো আব্বাকে দেন। জেলখানায় বসে আব্বা খাতাগুলো লিখেন। সবাই জানতেন শেখ মুজিবের এরকম লেখার কোন অভ্যাসই ছিল না। কেউ কখনো শুনেছেন উনি কিছু লিখেছেন। হঠাৎ করে উনার লেখা নিয়ে শেখ হাসিনার আমলে 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' প্রকাশিত হল। আব্বার এই খাতাগুলোর ন্যারেটিভ নিয়ে শেখ মুজিবের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি প্রকাশিত হয়েছে। আমি লেখাগুলো আগে পড়েছি। খাতার কিছু অংশ ভিজে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। বইয়েও সেরকমই অবস্থা, সেরকমই বর্ণনা। এই খাতার লেখাগুলো যদি শেখ মুজিবের নিজের লেখা হয় তাহলে সেটা জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শণ করা হোক সম্মানের সঙ্গে, সবার সামনে তুলে ধরা হোক যত্নের সঙ্গে। সবাই দেখুক সেটা। লেখা দেখে বুঝুক কোনটা কার লেখা। এখন দেখবেন খাতা দেখানোর কথা বললে বলবে সেটা হারিয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের শাসনামলে আমি আমার আব্বার এই খাতার লেখা দিয়ে বইটি প্রকাশ করা হয়েছে বলে চ্যালেঞ্জ ছু্ড়েছিলাম। দেশে অনুকূল পরিবেশ এলে এ বিষয়ে আইনের সাহায্য নেয়া হবে, আমার আব্বার খাতার বিষয়টি নিয়ে রিট করবো আমি। মন্ত্রী পর্যায়ের বেশ কয়েকজন লোক পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ বেশ কয়েকবার আমাদের গ্রামের বাড়ি থানারকান্দি আসেন। আমাকে একবার ঢাকার বিমানবন্দরে দীর্ঘক্ষন আটকে রাখা হয়। অনেকদিন দেশে আসতে পারিনি।'
আবুল খায়ের ফাউন্ডেশন নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা খায়ের মিয়ার ভ্রাতুস্পুত্র সৌদী আরব প্রবাসী মো. স্বপন মিয়া জানান, খায়ের মিয়া সাহেবের জীবনীভিত্তিক একটি বই তৈরীর চেষ্টা করছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বিএনপি'র দপ্তর সম্পাদক মাসুদুল ইসলাম মাসুম। খাতাগুলো হাতছাড়া হওয়ার বিষয়টি দিপু সাহেব যা বলছেন সেটাই হয়তো সত্য। আমরা ছোট ছিলাম তো এ বিষয়ে খুব একটি কিছু জানি না। তবে উনাদের গ্রীণরোডের বাড়িটি বিআরবি'র কাছে বিক্রির বিষয়টি জানি।' খায়ের মিয়ার নাতি জিয়াউল হায়দার জিয়া ছন্দ বলেন, আমার নানাবাড়িটি পীরের বাড়ি হলেও নানার ভাইরা যে পরিমান অত্যাচারের শিকার হয়েছে যে সেটা বলে বুঝানো যাবে না। নানা পীর হলেও উনার সব ভাইকে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন। খায়ের নানার ঢাকার বাসায় শের ই বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান সহ দেশের সব বরেন্য রাজনীতিবিদদের আনাগোনা ছিল। নানারা অন্নদা স্কুলে পড়লেও সেখানের শিক্ষার্থীদের অনেকের কাছেই তারা অপরিচিত। উনাদের বিষয়ে সঠিক ইতিহাসটি কাউকেই জানতে দেয়া হয়নি।'
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে খায়ের মিয়া সাহেব দীর্ঘদিন জেল খেটেছেন। সে সময় উনার আরো ২ ভাই আবুল হাসনাত মিয়া ও আবুল বরকত মিয়া রাজনৈতিক হয়রানী ও জেল জুলুমের শিকার হন। তারা সবাই একই সঙ্গে চলতেন। শেখ মুজিবের সবচেয়ে ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন খায়ের মিয়া। পাকিস্তান আমলে উনারা সবাই মুসলিম লীগ বাদ দিয়ে নতুন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন। পরে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে এটিই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার কারণে দল থেকে খায়ের মিয়া সহ ১৭ জন এমএনএ পদত্যাগ করেন। পাকিস্তান ডেমেক্রেটিক পার্টি নামে নতুন দল গড়ে খায়ের মিয়া ১৯৭০ এর নির্বাচনে অংশ নেন। নির্বাচনে হেরে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। পাকিস্তানের করাচি হয়ে তারা কানাডা স্থায়ী হন। ১৯৭৫ সালের পর খায়ের মিয়া আবার বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় মারা যান।
খায়ের মিয়ার ছেলে দিপু বলেন, 'জেলে থাকার সময় আব্বা খায়ের মিয়া সাহেব আমাদের কাছ থেকে চেয়ে বাঁধাই করা বড় খাতা নিয়েছিলেন। সেগুলোতে তিনি জেলে থাকার সময়কার রাজনৈতিক বিষয়গুলো লিখতেন। অনেকটা ডাইরি লেখার মতোই নিজের চিন্তা ভাবনাগুলো লিখে রাখতেন। এভাবে তিনি ৪টি খাতা লিখেন জেলে বসে। দেশ ছাড়ার সময় তিনি খাতাগুলো সঙ্গে করে নিয়ে যান। দেশে ফেরার পর সেগুলো তার আলমারিতেই ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর সেগুলো হাতবদল হয়ে আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে যায়। পড়ে জানতে পারি খায়ের মিয়া সাহেবের সে খাতার লেখা নিয়েই শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইটি তৈরী করা হয়।'
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করায় এলাকায় নিরাপদে যেতে পারেননি খায়ের মিয়ার পরিবার। উনার বড় ছেলে রাশেদুল হোসেন ও ছোট ছেলে ময়দুল হোসেন মার্শাল যুক্তরাষ্ট্র থাকেন। মেঝো ছেলে আশফাক হোসেন ও সেঝো ছেলে এ.কে দেলওয়ার হোসেন দিপু কানাডা থাকেন। খায়ের মিয়ার দুই মেয়ে বাংলাদেশে থাকেন। রাজনৈতিক নেতাদের চাপে পড়ে একটা সময় ধানমন্ডির গ্রিনরোডের ৬নং রোডের ৩/এ নং এর ২৬ কাঠার ঐতিহাসিক বাড়িটিও বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন খায়ের মিয়ার সন্তানরা। এই বাড়িতে বাংলার বাঘ একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সহ এদেশের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের যাতায়াত ছিল। নিরাপত্তার অভাবে খায়ের মিয়া ও তার ভাইয়ের পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য পরে বিদেশে স্থায়ী হয়ে যান।
পাকিস্তান আমলে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের সময় টাঙ্গাইলের মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক,
কুমিল্লার খন্দকার মুশতাক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-১, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এ.কে রফিকুল হোসেন খায়ের মিয়া যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-২ এবং গোপালগঞ্জের শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-৩ হন। আওয়ামী লীগের শাসনামলে এই ইতিহাসও বিকৃতি করা হয়। সে সময় শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-১ দেখিয়ে এই কমিটির নাম উইকিপিডিয়া সহ বিভিন্ন জায়গায় নতুন করে সংশোধন করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম পূর্নাঙ্গ কমিটি হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহুকুমা কমিটির নাম ঘোষণা করেন খায়ের মিয়া সাহেব। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সে সময় মহুকুমা ছিল। প্রথমে এর জেলা ছিল ত্রিপুরা, পরে কুমিল্লা। খায়ের মিয়ার ছেলে দিপু বলেন, 'আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের নেতৃত্বে ছিলেন আমার আব্বা। শেষের দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের অতিরিক্ত ভারতপ্রীতি ও আওয়ামী মুসলিম লীগ নামের সংগঠন থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়ার কারণে এই দল থেকে সরে যান আমার আব্বা আবুল খায়ের মিয়া সহ ১৭ জন এমএনএ। আমার কাকা আবুল বরকত, আবুল হাসনাতও এই দল ছেড়ে দেন। '
প্রকাশিত 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' বইয়ের ১১০ ও ১১১ পাতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের কৃষ্ণনগরে এ.কে রফিকুল হোসেন খায়ের মিয়ার বাড়িতে শেখ মুজিবুর রহমানের আসার কথা উল্লেখ আছে। কৃষ্ণনগর আব্দুল জব্বার হাই স্কুলের দ্বারোদঘাটন অনুষ্ঠান ও সেই স্কুল মাঠের জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ দেয়ার কথাও লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিতাস, পাগলা ও মেঘনা নদীতে নৌকায় বসে সৈয়দ আব্বাস উদ্দীন ও বেদার বখতের সুরেলা কন্ঠে গান শুনার কথাও লেখা হয়েছে সেখানে।
থানারকান্দির খায়ের মিয়া পাগলা নদী পার হয়ে বড়াইল হাই স্কুলের পাশে বড়াইল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উনার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু ও শেষ করেন। সে সময় তিনি বড়াইল কাজীবাড়িতে থাকতেন। পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্নদা হাই স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন। ৭ ভাইয়ের মধ্যে উনার বড় ভাই ছিলেন থানারকান্দির পীর সাহেব। অন্য ভাইদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করা হয়। স্কুল জীবন শেষে খায়ের মিয়া সহ বরকত মিয়া ও হাসনাত মিয়া ভর্তি হন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। পরবর্তীতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারনে এই তিন ভাইয়ের নাম অন্নদা হাই স্কুল বা বড়াইল হাই স্কুলের সাবেক শিক্ষার্থীদের কোন তালিকায় ঠাই পায়নি। উল্লেখ্য, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে সমৃদ্ধ এ.কে রফিকুল হোসেন খায়ের মিয়া যুক্তফ্রন্ট থেকে ১৯৫৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েও বিপুল ভোটে এম.এন.এ নির্বাচিত হন। উনার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচনে জামানত হারান। উনার একান্ত উদ্যোগে বাইশটি মৌজা নিয়ে নবীনগরে বাইশমৌজা বাজার সহ একাধিক কার্যকর শালিস ব্যবস্থা গড়ে উঠে। বর্তমানে উনার ছেলে ও এলাকাবাসীর উদ্যোগে আবুল খায়ের ফাউন্ডেশনের নামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দাতব্য চিকিৎসা সেবা অব্যাহত রয়েছে। নিরবে নিভৃতে আজও খায়ের মিয়ার কথা ইতিহাসের পাতায় ভেসে উঠে।
লেখক: ইমরুল সুমন
সিনিয়র জার্নালিস্ট ও লেখক।