জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মাটি যেন আজ কথা বলছে, রক্তের উত্তাপে ফুঁসছে, আর জনগণের ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাসের নামে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন—বুধন্তী, চান্দুরা, ও হরষপুর—ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর-বিজয়নগর) থেকে কেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল-আশুগঞ্জ) এর সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাবে স্থানীয় জনতার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিজয়নগরের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নেমেছে, তাদের কণ্ঠে একটাই দাবি—‘আমাদের উপজেলাকে দ্বিখণ্ডিত করা চলবে না!’ বুধবার, ২০ আগস্ট ২০২৫, সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টা ধরে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে তারা তাদের ক্ষোভের জ্বালা প্রকাশ করেছে।
এই অবরোধে মহাসড়কের দুই পাশে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়, যাত্রীদের মাঝে ভোগান্তি ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু বিজয়নগরের মানুষের দৃঢ়তা ছিল অটল। স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসে অবরোধ তুলে নেওয়া হলেও, জনতার হৃদয়ে জ্বলতে থাকা আগুন এখনো নিভে নি। দ্বিখণ্ডিত বিজয়নগর প্রতিরোধ সর্বদলীয় বাস্তবায়ন কমিটির নেতৃত্বে এই বিক্ষোভে অংশ নেন অ্যাডভোকেট ইমাম হোসেন, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আল জাবের, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মো. মোখলেছুর রহমান লিটন মুন্সি, হেফাজত নেতা মাওলানা শফিকুল ইসলাম, জামায়াত নেতা মোজ্জামেল হক, মো. শিহাব উদ্দিনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ। তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে স্বাধীনতার পর থেকে তিতাস পূর্বাঞ্চলের ১০টি ইউনিয়নের প্রতি অবিচারের দীর্ঘ ইতিহাস।
তারা বলেন, বিজয়নগর উপজেলাকে দ্বিখণ্ডিত করার এই প্রস্তাব শুধু ভৌগোলিক বিভাজন নয়, এটি এলাকার উন্নয়ন, সংস্কৃতি, ও ঐক্যের উপর সরাসরি আঘাত। বক্তারা জানান, এই তিনটি ইউনিয়ন ভৌগোলিকভাবে উপজেলা সদরের কাছাকাছি এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলোকে অন্য আসনের সঙ্গে যুক্ত করা মানে বিজয়নগরের মানুষের অধিকার ও পরিচিতি কেড়ে নেওয়া। নির্বাচন কমিশন (ইসি) ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি হিসেবে ৩০০টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্বিন্যাস করে খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে, যেখানে ৩৯টি আসনে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ থেকে তিনটি ইউনিয়ন ছিনিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবটি স্থানীয়দের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। গত ৩০ জুলাই এই খসড়া তালিকা প্রকাশের পর ১০ আগস্ট পর্যন্ত আপত্তি ও আপিল জমা দেওয়ার সময় ছিল। নির্বাচন কমিশনে জমা পড়েছে ১,৭৬০টি আবেদন, যার বেশিরভাগই এই সীমানা পুনর্বিন্যাস নিয়ে। আগামী ২৪ আগস্ট থেকে এই আপিলগুলোর শুনানি শুরু হবে, এবং শুনানির পর চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে ইসি। কিন্তু বিজয়নগরের মানুষ এই শুনানির জন্য অপেক্ষা না করে রাস্তায় নেমে তাদের প্রতিবাদ জানিয়েছে।
তাদের দাবি, এই সিদ্ধান্ত জনস্বার্থবিরোধী এবং এটি তাদের এলাকার উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বিক্ষোভে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দা মো. আলী হোসেন বলেন, “আমরা বিজয়নগরের মানুষ, আমাদের পরিচিতি আমাদের আসনের সঙ্গে জড়িত। এই তিনটি ইউনিয়ন আমাদের হৃদয়ের অংশ। এগুলো কেটে নিলে আমাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হবে।” একইভাবে, স্থানীয় একজন নারী নেত্রী ফাতেমা বেগম বলেন, “আমাদের গ্রাম, আমাদের মাটি, আমাদের অধিকার কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে না। আমরা রাস্তায় নেমেছি, দরকার হলে আরও কঠিন আন্দোলন করব।” এই বিক্ষোভ শুধু রাস্তা অবরোধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি ছিল বিজয়নগরের মানুষের ঐক্য ও সংহতির এক জ্বলন্ত প্রকাশ। স্থানীয়রা জানান, স্বাধীনতার পর থেকে তিতাস পূর্বাঞ্চলের মানুষ বিভিন্নভাবে অবহেলিত হয়ে এসেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে তারা পিছিয়ে রয়েছে। এখন আসন পুনর্বিন্যাসের নামে তাদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা তাদের জন্য অগ্রহণযোগ্য। নির্বাচন কমিশনের এই প্রস্তাবে গাজীপুরে একটি আসন বাড়ানো এবং বাগেরহাটে একটি আসন কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে। কিন্তু বিজয়নগরের মানুষের জন্য তাদের নিজস্ব আসনের অখণ্ডতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
তারা বলছেন, এই তিনটি ইউনিয়ন তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, ও অর্থনৈতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। এগুলো কেটে নেওয়া মানে তাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও ভবিষ্যৎ উন্নয়নের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। বিক্ষোভের সময় মহাসড়কে দীর্ঘ যানজটে আটকে পড়া একজন বাসযাত্রী মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমরা ভোগান্তিতে পড়েছি ঠিকই, কিন্তু বিজয়নগরের মানুষের দাবি আমরা বুঝি। তাদের এই আন্দোলন শুধু তাদের নিজেদের জন্য নয়, এটি সব অবহেলিত এলাকার মানুষের জন্য একটি লড়াই।” প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, “আমরা বিক্ষোভকারীদের দাবি নির্বাচন কমিশনের কাছে পৌঁছে দেব। তাদের আপিল শুনানির সময় বিবেচনা করা হবে।” তবে, স্থানীয়রা এই আশ্বাসে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। তারা জানান, চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে তাদের দাবি পূরণ না হলে আরও বড় আন্দোলনের প্রস্তুতি নেবেন তারা।
এই ঘটনা শুধু বিজয়নগরের নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতিটি অবহেলিত এলাকার মানুষের জন্য একটি প্রশ্ন তুলে দিয়েছে—কেন জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে? কেন তাদের পরিচিতি ও অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে? বিজয়নগরের এই আন্দোলন একটি স্থানীয় প্রতিবাদ হলেও, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে জনগণের স্বাধীন ইচ্ছা ও ঐক্যের শক্তি। এটি একটি স্পষ্ট বার্তা—মানুষ তাদের অধিকারের জন্য লড়তে প্রস্তুত, তাদের কণ্ঠ দমিয়ে রাখা যাবে না। নির্বাচন কমিশনের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিজয়নগরের এই আগুন জ্বলতে থাকবে, এবং এই আগুন শুধু রাস্তায় নয়, প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়বে।