দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। আখাউড়ার ইমিগ্রেশনে ঘুষের বাণিজ্য প্রকাশে, উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Wednesday, 13 August 2025

আখাউড়ার ইমিগ্রেশনে ঘুষের বাণিজ্য প্রকাশে, উল্টো সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলার


জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট। যেখানে সীমান্ত পারাপারের নামে যাত্রীদের স্বপ্ন ভাঙে, আশা ছিন্নভিন্ন হয়, আর ঘুষের অন্ধকার ছায়া প্রতিটি পাসপোর্টে কালো দাগ ফেলে। এই চেকপোস্টে ঘুষ বাণিজ্যের কালো হাতের কথা সামনে আনার সাহস দেখানোর জন্য দুই সাংবাদিক—দৈনিক যুগান্তরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টাফ রিপোর্টার ও আখাউড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ফজলে রাব্বি এবং আরটিভির আখাউড়া উপজেলা প্রতিনিধি ও আখাউড়া রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এখন মিথ্যা মামলার জালে আটকে পড়েছেন। 


গত ১২ আগস্ট, মঙ্গলবার বিকেলে, আখাউড়া থানায় ইমিগ্রেশন পুলিশের ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে এই মামলা দায়ের করেন। কিন্তু এই মামলার পেছনে লুকিয়ে আছে একটি ভয়ঙ্কর সত্য।


যে সত্য ফজলে রাব্বি ও সাদ্দাম হোসেন তাদের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উন্মোচন করেছেন। গত ৪ আগস্ট আরটিভি অনলাইনে এবং ৭ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে চলমান ঘুষ বাণিজ্য ও অনিয়মের বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠেছে। প্রতিবেদনগুলোতে উঠে এসেছে উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রহিম ও কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেনের ঘুষ গ্রহণ, যাত্রী হয়রানি, অবৈধ পারাপার, পাসপোর্টে ভুয়া সীল মারা, এবং চোরাচালান চক্রকে সুবিধা দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ। 


এই প্রতিবেদনগুলো যেন একটি পঙ্গু সমাজের ক্ষতচিহ্ন উন্মোচন করেছে, যেখানে মেডিকেল ভিসায় ভারতে চিকিৎসার জন্য যাওয়া অসহায় যাত্রীদের কাছ থেকে ৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ আদায় করা হচ্ছে। টাকা না দিলে ‘ডকুমেন্ট ঠিক নেই’ বা ‘মেডিকেল কনফার্মেশন ঝুঁকিপূর্ণ’—এমন অজুহাতে তাদের সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হয়। 


গোপন সূত্র ও ভুক্তভোগী যাত্রীদের অভিযোগে জানা গেছে, এই চেকপোস্টে প্রতিদিন গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ টাকা ঘুষ আদায় করছে একটি প্রভাবশালী চক্র, যার মাথায় রয়েছেন ওসি আব্দুস সাত্তার, এসআই আব্দুর রহিম, এবং কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন। এই চক্রের কার্যক্রম শুধু যাত্রীদের হয়রানি নয়, দেশের ভাবমূর্তিকেও কলঙ্কিত করছে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের আগরতলার বাসিন্দা নমিতা বণিক, যিনি গত ১৪ এপ্রিল বাংলাদেশে এসেছিলেন, তার ভিসার মেয়াদ ৬০ দিনের বেশি থাকার অনুমতি না থাকলেও তিনি অতিরিক্ত ১ মাস ২০ দিন অবৈধভাবে এদেশে ছিলেন। ২ আগস্ট তিনি আগরতলায় ফিরে যান, কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কেন? কারণ, এসআই আব্দুর রহিমের আইডি ব্যবহার করে তাকে পার করানো হয়, আর এর জন্য ওসি আব্দুস সাত্তার ও আব্দুর রহিম তার কাছ থেকে ৯৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন। এমনকি, ২২ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দির বাসিন্দা রুবেল মিয়াজি ও মোহাম্মদ ফেরদৌস চিকিৎসার জন্য ভারতে যাওয়ার চেষ্টা করলে আব্দুর রহিম তাদের কাছে ৪০ হাজার টাকা দাবি করেন। তারা রাজি না হওয়ায় ভারতীয় ইমিগ্রেশনে তাদের পাসপোর্ট নম্বর পাঠানো হয়, ফলে আগরতলায় পৌঁছে তাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। ফিরে এসে আব্দুর রহিম তাদের গালিগালাজ করেন এবং ৫ হাজার টাকা দিয়ে তারা ছাড় পান। এমন আরেকটি ঘটনায়, ২৩ জুলাই সকালে চারজন মেডিকেল ভিসাধারী যাত্রী ৮০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে লাইনে না দাঁড়িয়েই সীমান্ত পার হন। কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেন তাদের পাসপোর্ট নিয়ে ব্যারাক রুমে আব্দুর রহিমের হাতে তুলে দেন, আর যাত্রী ছাউনিতে বসে টাকা লেনদেন হয়। 



সিসিটিভি ফুটেজে এই দৃশ্য ধরা পড়েছে, যা এই চক্রের দুর্নীতির প্রকাশ্য প্রমাণ। এমনকি, ঢাকা কাস্টমস হাউসের নিষিদ্ধ ঘোষিত এক যাত্রীকে দেলোয়ার মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে পার করিয়ে দেন, যিনি পরে বেনাপোলে ধরা পড়েন। এই ঘটনা স্পেশাল ব্রাঞ্চ পর্যন্ত পৌঁছায়, কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই চক্রের প্রভাব এতটাই যে, দেলোয়ার হোসেন, যিনি কনস্টেবল হিসেবে শুধু যাত্রীদের শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করার কথা, তিনি তিন বছর ধরে ইমিগ্রেশন ডেস্কে বসে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। তিনি চোরাচালান চক্র ও লাগেজ পার্টিদের সঙ্গে যোগসাজশে সুবিধা দিচ্ছেন। ওসি আব্দুস সাত্তার ও দেলোয়ার একই উপজেলা (মুরাদনগর) এর বাসিন্দা হওয়ায় তাদের প্রভাব আরও বেশি। এই দুর্নীতির জালে শুধু যাত্রীরাই নয়, দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফজলে রাব্বি ও সাদ্দাম হোসেন এই সত্য উন্মোচন করায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। 



ফজলে রাব্বি বলেন, “আমরা পেশাগত দায়িত্ব থেকে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করেছি। এই মামলা হয়রানিমূলক এবং সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা।” সাদ্দাম হোসেন যোগ করেন, “সাংবাদিকের কাজ সত্য প্রকাশ করা, ভয় বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করা নয়। সঠিক তদন্ত হলে দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে।” আখাউড়া থানার ওসি মো. ছমিউদ্দিন মামলাটি নথিভুক্ত করেছেন, দাবি করে বলেন, এটি চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে। কিন্তু সাদ্দাম হোসেন প্রশ্ন তুলেছেন, “তদন্ত ছাড়াই মামলা রুজু করে ওসি ছমিউদ্দিন প্রমাণ করেছেন তিনি নিরপেক্ষ নন। এটি সাংবাদিকতার ওপর সরাসরি আঘাত।” আখাউড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন লিটন বলেন, “সত্য প্রকাশের জন্য এই মামলা একটি মিথ্যা ষড়যন্ত্র। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবি করছি।” আখাউড়া রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রুবেল আহমেদ বলেন, “এটি গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আঘাত। সরকারের কাছে দাবি, সাংবাদিকদের নির্ভয়ে কাজ করার পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক।” আখাউড়া সাংবাদিক কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, “দুর্নীতি প্রকাশ করলেই যদি মামলা হয়, তাহলে সত্য প্রকাশ বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা সাংবাদিকদের পাশে আছি এবং মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি। অন্যথায় বৃহত্তর কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।” এই ঘটনা শুধু আখাউড়ার নয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকতার স্বাধীনতা ও সত্য প্রকাশের সংগ্রামের একটি প্রতীক। যখন সাংবাদিকরা সত্যের জন্য লড়াই করেন, তখন তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলার তলোয়ার ঝোলানো হয়। কিন্তু এই তলোয়ার কি সত্যকে চাপা দিতে পারবে? নাকি ফজলে রাব্বি ও সাদ্দাম হোসেনের মতো সাহসী সাংবাদিকরা সত্যের মশাল জ্বালিয়ে রাখবেন? এই প্রশ্ন এখন প্রতিটি পাঠকের বিবেকের কাছে।