খুলনা প্রতিনিধি :
শান্ত শহর খুলনা এখন আতঙ্কের নগরী। রাত হলেই আতঙ্কে প্রহরগুনে শহরবাসী। গেল ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে তিনজনকে হত্যা এবং একজন গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় হতবিহ্বল নগরবাসী। এসব ঘটনার মোটিভ উদঘাটিত হলেও প্রকৃত সন্ত্রাসীরা ধরা পড়েনি। হত্যাকারী চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা সব সময়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
গত ১১ মাসে খুলনা শহরেই ৩৩টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। গুলি করে ও কুপিয়ে গুরুতর আহতের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। সম্প্রতি বাড়িতে ঢুকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নতুন করে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে খুলনা জুড়ে।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত ১ আগস্ট রাতে নিজ বাড়িতে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে খুন হয় সোনাডাঙ্গা থানাধীন সবুজবাগ এলাকার যুবক মনোয়ার হোসেন টগর। দুর্বৃত্তরা ওই রাতে টগরের বাড়ির দরজা নক করে সেখানে তার সঙ্গে ৫ মিনিট ধরে কথোপকথনের একপর্যায়ে বুকে ছুরিকাঘাত তাকে হত্যা করে। এ ঘটনায় বাড়ির আশপাশের সিসি ফুটেজ সংগ্রহ করে আসামিদের শনাক্ত করতে পারলেও তাদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
একইদিন রাতে দিঘলিয়ায় ভ্যানচালক আল আমিন শিকদারকে বাসা থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে তার স্ত্রীর পূর্বের স্বামী আসাদুল। আসাদুলকে আসামি করে নিহতের ভাই মামলা করলেও এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা যায়নি তাকে।
এ ছাড়া রাত পৌনে ৮টার দিকে নগরীর ২ নম্বর কাস্টমঘাট এলাকার একটি সেলুনের সামনে অবস্থান নেওয়া যুবক সোহেলকে হত্যার উদ্দেশ্যে লক্ষ্য করে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। এ সময়ে সন্ত্রাসীরা ৪টি মোটরসাইকেলে আসে সন্ত্রাসীরা। তাদের সবার মাথায় হেলমেট এবং মুখে কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। সন্ত্রাসীর ছোড়া একটি গুলি সোহেলের পেটে বিদ্ধ হয়। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সোহেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এদিকে একই রাতে মোটরসাইকেলে চলন্ত অবস্থায় নগরীর মহেশ্বরপাশা উত্তর বণিকপাড়া এলাকার খানা বাড়ির সামনে দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলাকেটে হত্যা করে ঘের ব্যবসায়ী আল আমিনকে। ঘটনার ১২ ঘণ্টার বেশী সময় অতিবাহিত হলেও এ ঘটনায় পুলিশ এখনও পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, সোমবার সকালে নিহত আল আমিনের ভাই আওলাদ হোসেন বাদী হয়ে অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। ঘটনাস্থলে আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলো নষ্ট থাকায় খুনিদের শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।
স্থানীয়দের তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, আল আমিন ২০১৬ সালের পর থেকে মহেশ্বরপাশা এলাকা ছেড়ে দিয়ে বাদামতলার ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। সে মাঝেমধ্যে ইজিবাইক চালত। এর আগে গত ১১ জুন ওই একই এলাকায় খুন হন যুবদল নেতা মাহাবুব মোল্লা। মাহাবুব মোল্লা হত্যাকাণ্ডে এ পর্যন্ত চারজনকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠিয়েছে পুলিশ।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ৩ আগস্ট পর্যন্ত খুলনা মহানগরীতে ৩১টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় ২৫টি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের আগস্টে দুটি, সেপ্টেম্বরে একটি, অক্টোবরে দুটি, নভেম্বরে চারটি ও ডিসেম্বরে সর্বোচ্চ ৬টি হত্যার ঘটনা ঘটে।
চলতি বছরের শুরুতে জানুয়ারি মাসে খুন হন দুজন, ফেব্রুয়ারিতে একজন, মার্চে একজন এবং এপ্রিল, মে, জুন মাসে ও জুলাই মাসের এ পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছেন সাতজন। নগরীর ৮টি থানার মধ্যে খানজাহান আলি থানায় সেপ্টেম্বরে প্রথম হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সেপ্টেম্বরে, অক্টোবরে হরিনটানা থানা এলাকায় খুন হয় একজন, নভেম্বরে সোনাডাঙ্গা থানা, লবনচরা থানায় একজন করে দুজন, ডিসেম্বরে সদর থানা এলাকায় দুজন, খালিশপুর থানা এলাকায় দুজন, দৌলতপুর থানা এলাকায় একজন ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় একজন খুন হন।
জানুয়ারিতে সদর থানা ও সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় দুজন, ফেব্রুয়ারিতে সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, মার্চ মাসে সদর থানা এলাকায় একজন, এপ্রিল মাসে সদর থানা এলাকায় ও আড়ংঘাটা থানা এলাকায় দুজন, মে মাসে সদর থানা এলাকায় একজন, সোনাডাঙ্গা থানা এলাকায় একজন, লবনচরা থানা এলাকায় দুইজন ও হরিণটানা থানা এলাকায় একজন খুন হয়, জুন মাসে সোনাডাঙ্গা ও ও হরিণটানা থানা খুন হন দুজন।
তবে এসব ঘটনার বেশিরভাগই আসামি গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে। তবে আসামিরা আদালতের মাধ্যমে জামিনে বের হয়ে আবারও একই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে খুলনার নাগরিক সমাজের সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, খুলনার মানুষ সব সময়ই শান্তি প্রিয়। তারা শান্তিতে জীবনযাপন করতে চান। কিন্তু শান্তি আর নেই। সন্ধ্যা নামলেই খুলনাবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। এখন আবার শুরু হলো প্রকাশ্য দিবালোকে। তিনি আরও বলেন, খুলনার পুলিশ প্রশাসন আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে এখন চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সাধারণ মানুষ হিসেবে এমন অবস্থা কাম্য নয়।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের সহকারী কমিশনার (মিডিয়া) খন্দকার হোসেন আহমদ মিডিয়াকে বলেন, খুলনাবাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা টহল বাড়িয়েছি, বিশেষ চেকপোস্ট দিয়েছি শহরের বিভিন্ন জায়গায়। এ ছাড়া যে খুনগুলো হচ্ছে এগুলোর বেশিরভাগই টার্গেট কিলিং। আমরা প্রত্যেকটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের অল্প সময়ের মধ্যেই গ্রেপ্তার করেছি। আদালতের মাধ্যমে কোনো আসামি ছাড়া পেয়ে গেলে সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না।
তিনি আরও বলেন, আমরাও বিষয়গুলো নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি। সম্প্রতি শহরে দুটি খুনের ঘটনা ঘটেছে। প্রত্যেকটি ঘটনায় পুলিশের একাধিক টিম তদন্ত করছে। খুব শিগগির আসামিরা গ্রেপ্তার হবে বলে আশা প্রকাশ করছি।