দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ নতুনভাবে গড়তে বাংলাদেশ-জাপান একসঙ্গে কাজ করতে পারে’ - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

Thursday, 29 May 2025

‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ নতুনভাবে গড়তে বাংলাদেশ-জাপান একসঙ্গে কাজ করতে পারে’


জাতীয় প্রতিবেদক :
এশিয়ার ভবিষ্যৎ নতুনভাবে রচনা করতে বাংলাদেশ ও জাপান একযোগে কাজ করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আজ বৃহস্পতিবার টোকিওতে ‘নিক্কেই ফোরাম: ৩০তম ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়।


ভাষণে ড. ইউনূস বলেন, ‘আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমার কিছু স্মৃতি জেগে উঠছে। ২০০৪ সালে, আজ থেকে ২০ বছর আগে, নিক্কেই আমাকে এশিয়া পুরস্কারে ভূষিত করেছিল। আমার জীবনের এক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মুহূর্ত ছিল সেটি। সেই থেকেই জাপানের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত এক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এরপর বহুবার জাপানে এসেছি, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে কাজ করেছি, তরুণদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছি। জাপানের মানুষ যেভাবে আমার সামাজিক ব্যবসা ও ক্ষুদ্রঋণের ধারণাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছেন, তাতে আমি গভীরভাবে মুগ্ধ।’


তিনি বলেন, ‘আজ আমরা এক অস্থির বিশ্বের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করতে এখানে একত্র হয়েছি। এই বিশ্ব দিন দিন আরও অস্থির হয়ে উঠছে। আমরা এমন এক অনিশ্চয়তার সময় অতিক্রম করছি যেখানে শান্তি ভঙ্গুর, উত্তেজনা বাড়ছে এবং সহযোগিতা সবসময় নিশ্চিত নয়। এশিয়া ও এর বাইরের বহু অঞ্চলে সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে, শান্তি অধরা হয়ে উঠছে।’


ড. ইউনূস বলেন, ‘ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজার হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করছে। মিয়ানমারে ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে, সাম্প্রতিক ভূমিকম্প সেখানে এক মানবিক সংকটকে আরও ঘনীভূত করেছে। সম্প্রতি আমাদের দুই প্রতিবেশী একটি স্বল্পকালীন হলেও ব্যয়বহুল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। আমরা দুঃখজনকভাবে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করছি, অথচ লাখ লাখ মানুষ অনাহারে বা মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ। শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ায় আমি দুই দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানাই এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও স্থিতিশীলতা কামনা করি।’


তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে। প্রযুক্তি অগ্রগতি এনেছে, তবে এর ফলে নতুন নৈতিক সংকটও তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা মুক্ত বাণিজ্যের মূল ভিত্তিকেই চ্যালেঞ্জ করছে। দেশে দেশে ও সমাজের ভেতরে বাড়ছে বৈষম্য, কমছে আস্থা। জাতিগুলোর মধ্যে, সমাজের মধ্যে এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যেও আস্থা হ্রাস পাচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় আমরা যে বিভাজন ও অস্থিরতা দেখেছি, তা শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের পথ উন্মুক্ত করেছে।’


ড. ইউনূস তাঁর বক্তব্যে বাংলাদেশের জুলাই অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘গত বছর বাংলাদেশে ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় আমার সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। আমরা জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে, ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা ও মানুষের মর্যাদা নিশ্চিত করতে এবং গণতন্ত্রে মসৃণ উত্তরণের লক্ষ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের জন্য কাজ করছি। আমরা বিশ্বাস করি, এটি ভুল শুধরে নেওয়ার, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ার এবং একটি আরও ন্যায্য সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ।’


তিনি আরও বলেন, ‘একাধিক অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি-প্রতিষ্ঠার মিশনে অংশ নিয়ে বৈশ্বিক শান্তিতে ভূমিকা রাখছে। পাশাপাশি, মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশ মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে।’


ড. ইউনূস বলেন, ‘এশিয়া বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসভূমি। বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার কেন্দ্রবিন্দুতে এখন এশিয়া, তবে এটিই সম্ভাবনার কেন্দ্রও। আমাদের সম্মিলিত শক্তি বিশাল এবং আমি বিশ্বাস করি, এশিয়ার দায়িত্ব আছে একটি ভিন্ন পথ দেখানোর—শান্তি, সংলাপ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রগতির পথ। শুধু সংখ্যায় নয়, মানুষের কল্যাণে, আস্থা ও আশায় উন্নতি ঘটানোই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত।’


তিনি বলেন, ‘আমি প্রায়ই বলি—টাকা বানানো একরকম সুখ, কিন্তু মানুষকে খুশি করা হলো পরম সুখ। আমাদের মনোযোগ ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সম্মিলিত কল্যাণে, স্বল্পমেয়াদি লাভ থেকে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়ে যেতে হবে। আমার ব্যক্তিগত যাত্রায়—গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে দরিদ্র গ্রামীণ নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে সামাজিক ব্যবসার ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত—আমি শিখেছি, মানুষ কষ্টে থাকার জন্য জন্মায়নি। মানুষ জন্ম নেয় সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে। আমাদের দায়িত্ব, তাদের জন্য সেই সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়া।’


ড. ইউনূস ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, এশিয়ার দেশগুলো অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এবং নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে পারে। আমাদের দরকার একটি অভিন্ন ভবিষ্যৎ এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়ার স্পষ্ট দিকনির্দেশনা।’


ভাষণের শেষ অংশে তিনি ছয়টি প্রস্তাবনা দেন। নিক্কেই ফোরামকে তিনি ‘আশার প্ল্যাটফর্ম’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন, ‘নিক্কেই এমন এক জায়গা তৈরি করেছে, যেখানে সংলাপ সমাধানের দিকে এগিয়ে যায়, আর ‘আস্থা’ কেবল একটি শব্দ নয়, বরং একটি লক্ষ্য—যার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করি। এশিয়ার ভবিষ্যৎ কেবল অর্থনীতি বা ভূরাজনীতি নয়, এটি মানুষের বিষয়, ধারণার বিষয়, সাহসের বিষয়।’


ড. ইউনূস বলেন, ‘আমরা চারপাশের ঝড় দেখে ভয় পাব না, বরং এটিকে আহ্বান হিসেবে গ্রহণ করব—পুনরায় ভাবার, পুনর্গঠনের এবং সম্মিলিতভাবে উঠে দাঁড়ানোর আহ্বান। চলুন, আমরা ভয় নয়, সম্ভাবনা দ্বারা চালিত হই। ক্ষমতা নয়, উদ্দেশ্য দ্বারা পরিচালিত হই। চলুন আমরা একটি উন্নত ভবিষ্যৎ কল্পনার সাহস করি। একে অপরকে বিশ্বাস করি এবং একসঙ্গে সহযোগিতা করি—কারণ আমাদের তা করতে হবে বলে নয়, আমরা তা চাই বলেই। এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি। চলুন আমরা একসঙ্গে তা লিখি। বাংলাদেশ ও জাপান এশিয়া এবং বিশ্বের ভবিষ্যৎ রচনায় একসঙ্গে কাজ করতে পারে।’