জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের ঊর্ধ্বতন নেতাকর্মীদের বৈচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। একে ঘিরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নাশকতার শঙ্কা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
সোমবার সকালে রাজধানীর শিশু একাডেমিসংলগ্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটকের কাছে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। ওই এলাকায় সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে ডিএমপি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঝটিকা মিছিল ও ককটেল উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গভীর রাতে ও ভোরবেলায় ব্যানার নিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানও দিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। নাশকতার ছক তৈরি করছে আওয়ামী লীগ এ অভিযোগও রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ঝটিকা মিছিলে যারা যোগ দিয়েছে বা নাশকতা সৃষ্টি করছে তাদের ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গ্রেপ্তারও করা হচ্ছে। হাইকোর্টকেন্দ্রিক নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে সরকার। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধীর বিচার কার্যক্রম শুরু হলে হাইকোর্ট এলাকায় ঝটিকা মিছিল, ককটেল বিস্ফোরণসহ নানা নাশকতা সৃষ্টির চেষ্টা করে দলটির নেতাকর্মীরা। তারপরও সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টার কথা জানিয়েছে পুলিশ।
ট্রাইব্যুনাল সংলগ্ন এলাকায় ককটেল বিস্ফোরণ বা নগরীতে ঝটিকা মিছিল করে যারাই নাশকতা করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে ডিএমপির অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মাদ তালেবুর রহমান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর সাংবাদিকদের বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। যারাই দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাইবে, নাশকতা করবে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশের নজরদারি রয়েছে।
ককটেল বিস্ফোরণ: সোমবার সকাল ৭টায় রাজধানীর শিশু একাডেমি সংলগ্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটকের কাছে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটেছে। শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘সোমবার ভোরে এ বিস্ফোরণ হয়েছে। একটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে, অবিস্ফোরিত অবস্থায় আরেকটি পাওয়া গেছে। এ বিষয়ক আইনগত প্রক্রিয়া চলছে।’
সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলার শুনানি হয়েছে। সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পুলিশের তৎকালীন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনও এ মামলার আসামি। শুনানি ছিল দুপুরে। আর ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে সকালে। গত ১ জুন শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান ও মামুনের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি ছিল। সেদিনও একই জায়গায় (শিশু একাডেমিসংলগ্ন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ফটকের সামনে) ‘ককটেলসদৃশ পটকা’ বিস্ফোরণের কথা জানিয়েছিল শাহবাগ থানা-পুলিশ। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর বলেন, ‘আগের বিস্ফোরণের ঘটনায় থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। তবে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
নিরাপত্তা জোরদারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি: আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার এবং ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নোট দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বলা হয়েছে, এ বিচার প্রক্রিয়া দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়; বিচারক, সাক্ষী ও বিচার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সবার জন্য পরিস্থিতি খুব ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ট্রাইব্যুনালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের চারপাশে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা, পর্যাপ্তসংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী মোতায়েন করা, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে সার্বক্ষণিক নজরদারি নিশ্চিত করা, সাক্ষী ও বিচারকদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা, আসামিদের আনা-নেওয়ার পথগুলোতে কঠোর নিরাপত্তা প্রটোকল তৈরি করতে অনুরোধ জানানো হয়েছে চিঠিতে।
বৈচারিক এলাকায় ডিএমপির সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা: গত ১২ জুন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) হাইকোর্টের আশপাশের সব স্থানে সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। প্রধান বিচারপতির সরকারি বাসভবন, বিচারপতি ভবন, জাজেস কমপ্লেক্স, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের প্রধান গেট, মাজার গেট, জামে মসজিদ গেট, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ১ ও ২-এর গেট, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট ভবনের সামনে এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। গত ১৪ জুন বিজ্ঞপ্তি কার্যকরের নির্দেশনা ছিল। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত এটি কার্যকর থাকবে।
ঢাবিতে ছাত্রলীগের মিছিল ও ককটেল উদ্ধার: রাজধানীর শাহবাগ ও কাঁটাবন মোড়ের মধ্যবর্তী এলাকায় ঝটিকা মিছিল করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। মিছিল শেষে তারা শাহবাগ সড়কসংলগ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিবুর রহমান হলের পকেট গেটের সামনে দুটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। ঢাবির কাজী মোতাহার হোসেন ভবন প্রাঙ্গণ থেকে অবিস্ফোরিত ছয়টি ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। ঝটিকা মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের পরিচয় সম্পর্কে এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ মুজিবুর রহমান হলের শিক্ষার্থী বিলায়েত শেখ বলেন, “ভোরের নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ ‘জয় বাংলা’ এবং ‘শেখ হাসিনা’ স্লোগানে ঘুম ভেঙে যায়। আনুমানিক ৫টা ৫০ মিনিটে মিছিলটি শাহবাগ থেকে এসে বঙ্গবন্ধু হলের পকেট গেটে পৌঁছায়। পরে তারা বিভিন্ন গলিতে সরে যায়। এর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের হলের পকেট গেটের সামনে পরপর দুটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়।”
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ওসি খালিদ মুনসুর বলেন, ‘আমরা নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের একটি মিছিল কাঁটাবন মোড় এলাকায় হতে দেখি। ধাওয়া দিলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে মিছিলে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা হবে।’
সোমবার সকালে কাজী মোতাহার হোসেন ভবনের সামনে নিরাপত্তারক্ষীরা ছয়টি ককটেলসদৃশ বস্তু দেখতে পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিম ও শাহবাগ থানা পুলিশকে অবহিত করেন। সকাল ৯টার পর বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের একটি দল ককটেলগুলো উদ্ধার করে।
ঢাবির সহকারী প্রক্টর (আইন অনুষদ) ড. এনামুল হক সজীব ককটেল উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘আমরা সেখানে দুটি ওয়ানটাইম বক্সে ছয়টি ককটেল দেখতে পাই। একটিতে চারটি ও অন্য আরেকটি বক্সে দুটি ককটেল ছিল। পরে শাহবাগ থানায় জানালে তাদের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সেগুলো উদ্ধার করে। কারা রেখে গেছে তা জানতে পারিনি। আজ এখানে বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
মোহাম্মদপুর ও মানিকগঞ্জে ঝটিকা মিছিল: সোমবার সকাল ৭টায় মোহাম্মদপুর কলেজ গেটের মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের সামনে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ঝটিকা মিছিল করেন। তারা ‘শেখ হাসিনার বিচার মানি না মানব না’ ব্যানারে মুখে মাস্ক পরে বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দেন। গত রবিবার সকালে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার নয়াডিঙ্গি রাইজিং ফ্যাক্টরির সামনে ঝটিকা মিছিল করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে ওই এলাকার ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিদুল ইসলাম তার নিজের ফেসবুক পেজে মিছিলের ছবি এবং ভিডিও পোস্ট করেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন দৌলতপুর উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শফিকুল ইসলাম এবং জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এজাহারভুক্ত আসামি। তাকে পেলেই গ্রেপ্তার করা হবে।’