গত দেড় দশকে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দেশ থেকে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংক দখল করে ভুয়া ঋণগ্রহণ এবং সরকারি প্রকল্পের টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করা হয়েছে এসব টাকা। এখন পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি শেষ করেছে সরকার। পাশপাশি যেসব দেশে এসব অর্থ রয়েছে, সেখানে কূটনৈতিক জাল বিছিয়েছে সরকার, শুরু করেছে বিশেষ কার্যক্রম। যাতে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত পাচারকারীরা অর্থ সরাতে বা কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে।
দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের প্রধান গন্তব্যের মধ্যে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ক্যামেন আইল্যান্ড এবং ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড অন্যতম।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। এর পর থেকে তার দল আওয়ামী লীগ, অঙ্গ, সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ নেতারাও বিদেশে পালিয়ে যান। ধারণা করা হচ্ছে, বিদেশে থেকে পাচার করা অর্থ দিয়ে তারা এখন দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক ও সমাজিক অস্থিরতা তৈরি করছেন। ফলে বিদেশে আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থকদের কার্যক্রমের লাগাম টানতে সরকার সেসব দেশের পাচার হওয়া অর্থ জব্দের উদ্যোগ নিয়েছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারপ্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেছে। পরে দেশের আদালতে মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে পাচারের অর্থ ফেরত আনা হবে বলে জানা যাচ্ছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের শ্বেতপত্র : গত বছর ডিসেম্বরের শুরুতে ‘বাংলাদেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি’ একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। কমিটি দুর্নীতি, অনিয়ম, লুটপাটসহ অর্থনীতির নানা বিষয়ে তাদের প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার শ্বেতপত্র তৈরি করে। শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য শ্বেতপত্র প্রকাশ অনুষ্ঠানে বলেছেন, আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ২৮ উপায়ে ‘চামচা পুঁজিবাদ থেকেই চোরতন্ত্র’ তৈরি হয়েছিল, যাতে রাজনীতিক, সামরিক ও বেসামরিক আমলা, বিচার বিভাগসহ সবাই অংশ নিয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে ১৫ বছরে তারা দেশ থেকে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করেছে।
এক বিবৃতিতে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিতে ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বিবৃতিতে তিনি সন্দেহভাজন অর্থ পাচারকারী, দুর্নীতি ও চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারে সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্য সফরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশটির প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের সঙ্গে বৈঠকের অনুরোধ জানালেও শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। তবে সফরকালে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েল অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং সরকারের সর্বোচ্চ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সফরে দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎ করেন। প্রধান উপদেষ্টা রাজা চার্লসের পুরস্কার গ্রহণ করেন। এ সময় তিনি চ্যাথাম হাউজে বক্তব্য এবং অর্থপাচারসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বক্তব্য রাখেন।
প্রধান উপদেষ্টার সফরকালে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সম্পদ জব্দ করেছে দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাইফুজ্জামানের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে বলা হয়েছে।
সফরে অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, আগামীতে তার আরও যুক্তরাজ্য সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। তার প্রশাসন যুক্তরাজ্যের ব্যবসা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ সব দিক থেকে সহায়তা পেতে চাচ্ছে। পাশাপাশি ব্রিটেনের জনগণের সমর্থন চেয়েছেন তিনি।
প্রধান উপদেষ্টার একজন সফরসঙ্গী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিগত সময়ে দেশ থেকে যেসব অর্থ পাচার হয়েছে, তার বড় গন্তব্য ছিল যুক্তরাজ্য। সেখানকার সরকার ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সে বিষয়ে অবহিত করা এবং তাদের সহযোগিতা চাওয়াই প্রধান উপদেষ্টার সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে যুক্তরাজ্য সরকারের সঙ্গে নেওয়া যৌথ প্রচেষ্টা বাংলাদেশ জোরদার করেছে। পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল প্রক্রিয়া। তাই এ কাজে গতি আনতেই অন্তর্বর্তী সরকার প্রচেষ্টা আরও জোরদার করেছে। যুক্তরাজ্যের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জনাথন পাওয়েলের সঙ্গেও এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা আলোচনা করেছেন।
তবে সরকার চাইলেই অর্থ ফেরত আনা সম্ভব নয় বলে একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম থেকে জানানো হয়েছে। এক্ষেত্রে সেদেশের আইন ও তাদের আন্তরিকতার বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকার মূলত পাচারকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেসব তথ্যপ্রমাণ পেয়েছে। সেসব তথ্য দেশটির হাতে তুলে দেওয়া। যাতে তারা সে দেশের আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের (পাচারকারীদের) শান্তি নিশ্চিত করতে পারে বা তাদের সম্পদ জব্দ করতে পারে। আর এটি সম্ভব হলে দেশে আইনগত প্রক্রিয়া (মামলা) শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত পাচারকারীরা অর্থ উত্তোলন বা কোনো ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে না। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে সরকার ইতিমধ্যে সংশ্লিষ্ট দেশে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তদের অর্থ আত্মসাতের তথ্যপ্রমাণ সেসব দেশের সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রেরণ করছে। এ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন এ বিষয়ে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার সফরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার সাক্ষাৎ না করার বিষয়ে জানা যাচ্ছে, অধ্যাপক ইউনূসের সফরকালে স্টারমার তাদের জাতীয় বাজেট সংশ্লিষ্ট কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে জাতীয় নিরাপত্তা প্রধানকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার জন্য বিশেষভাবে পাঠিয়েছেন। তিনি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে অধ্যপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে এবং সরকারকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। ইতিমধ্যে সেদেশে পাচারকারীদের অর্থ জব্দ করা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং তথ্যপ্রমাণ থাকলে সরকারের পাশে থাকবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।
অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, যুক্তরাজ্যে নির্বাচনকালে স্টারমারকের প্রচার-প্রচারণায় আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ী ও তাদের সমর্থিত ব্রিটিশ নাগরিকরা ব্যাপক অর্থ সহায়তা করেছে। নির্বাচনে জয়লাভের পেছেনে শেখ হাসিনার বোনের মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিকীর অবদান ছিল। ফলে টিউলিপ সিদ্দিকীকে মন্ত্রীও করা হয়েছে। তার খালার সঙ্গে আর্থিক কেলেঙ্কারির জের ধরে গত জানুয়ারিতে সিটি মিনিস্টারের পদ ছাড়তে বাধ্য হন টিউলিপ। সেসব বিষয় বিবেচনায় হয়তো যুক্তরাজ্য প্রধানমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন।
অর্থপাচারের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এখন সেগুলোকে যৌক্তিক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হবে। কেবল যুক্তরাজ্য নয়, দুবাই, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়াসহ আরও যেসব দেশে অর্থপাচার হয়েছে, সেখান থেকেও অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।
তিনি বলেন, অর্থপাচারের বিষয়টি আগে দেশের আদালতে প্রমাণিত হতে হবে। তারপর যেসব দেশে পাচার হয়েছে, সেসব দেশের কর্তৃপক্ষকে সে বিষয়টি অবহিত করে অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে উদ্যোগ নিতে হবে। আদালতের রায়ের ভিত্তিতে প্রথমে পাচার হওয়ার অর্থ জব্দ করতে হবে। এরপর সেটির নগদায়ন, তারপর প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে দক্ষতার সঙ্গে কাজ সম্পন্নের জন্য এসব কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে হবে।