জহির শাহ্, অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদন
একটি রাষ্ট্রের গণতন্ত্র কেবল কাগজে লেখা সংবিধান বা রংচঙে রাজনৈতিক প্রচারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রাণ হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্য ও কার্যকর একটি নির্বাচন কমিশন (ইসি)—যে প্রতিষ্ঠানটি জনগণের ভোটের পবিত্রতা রক্ষা করে, এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ স্থানান্তর নিশ্চিত করে। বাংলাদেশেও সংবিধান এই উচ্চাভিলাষী ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে নির্বাচন কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—এখনো কি সেই মূল আদর্শের পথে হাঁটছে এই প্রতিষ্ঠান? নাকি এটি পরিণত হয়েছে একটি নিয়ন্ত্রিত রোবট-সদৃশ যন্ত্রে, যেখানে কেবল গাইডলাইন আসে উপরের দিক থেকে?
আজ আমরা সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করব—ফাইল ঘেঁটে, অভিযোগ বিশ্লেষণ করে, এবং সাধারণ ভোটারের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি যাচাই করে। চলুন প্রবেশ করি বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থার গভীরে, যেখানকার বাস্তবতা প্রায়শই আমাদের আশাভঙ্গ করে, কিন্তু পরিবর্তনের সম্ভাবনাও ঠিক ততটাই বাস্তব।
✦ নির্বাচন কমিশনের কাঠামো ও সাংবিধানিক ভিত্তি: কাগজে শক্ত, বাস্তবে দুর্বল?
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, একটি প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও সর্বোচ্চ চারজন কমিশনার নিয়ে গঠিত হবে নির্বাচন কমিশন। তাদের নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মেয়াদ হবে পাঁচ বছর এবং তারা সংবিধান ও আইন অনুযায়ী স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করবেন।
এ পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই মনে হয়। আরও নিরাপত্তা দিতে ২০০৯ সালে ‘ইসি সচিবালয় আইন’ এবং ২০২২ সালের ‘নিয়োগ আইন’ পাস করা হয়েছে, যা অনুসন্ধান কমিটি গঠনের মাধ্যমে কমিশনার নিয়োগের নিয়ম নির্ধারণ করে। সেই কমিটিতে থাকেন বিচারপতি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং অন্যান্য রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব।
তবে এই কাঠামোটি কি বাস্তবে গণতন্ত্র রক্ষায় যথেষ্ট কার্যকর? অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ‘কাগজে কলমে স্বাধীনতা’ আর বাস্তব ‘প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ’-এর মধ্যকার ব্যবধানটি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে।
✦ নির্বাচনের ইতিহাস: ২০১৪, ২০১৮, ২০২৪—অবিশ্বাসের দাগ
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতি বিশ্বাসে বড়সড় ফাটল ধরিয়েছে।
২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলোর বর্জন,
২০১৮-তে আগেই ভোটব্যালট ভর্তি করার অভিযোগ,
এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিরোধীদের অন্তর্ভুক্ত না থাকায় স্বতঃসিদ্ধ বিজয়—সব মিলিয়ে নির্বাচনের প্রকৃত অর্থই যেন ফিকে হয়ে যায়।
জনগণের এই আস্থা হারানোর প্রক্রিয়াটি রীতিমতো উদ্বেগজনক। এমনকি ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সহ ২০ জনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক আচরণের অভিযোগও ইসির নিরপেক্ষতার প্রশ্নকে আরেক ধাপ বাড়িয়ে দেয়।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—এইসব অভিযোগ কী নির্বাচন কমিশনের গায়ে ধুলোমাত্র, নাকি গলার কাঁটা?
✦ আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা
২০২৪ সালের এক স্বাধীন রিপোর্ট বলছে, ইসি গঠনের ক্ষেত্রে আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ আশঙ্কাজনক মাত্রায় বৃদ্ধি পেয়েছে। যখন রাজনীতির বাইরের কোনো নিরপেক্ষ শক্তি এই নিয়োগে অংশ নেয় না, তখন পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হয়ে ওঠে একপ্রকার “ফিক্সড ম্যাচ”।
এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছেই—নিয়োগে যদি পক্ষপাত থাকে, তবে দায়িত্ব পালনে নিরপেক্ষতা আশা করা কি অমূলক নয়?
✦ প্রশাসনিক দুর্বলতা ও অর্থ কেলেঙ্কারি: সাড়ে সাত কোটি টাকার ট্রেনিং!
২০২৫ সালের জুলাইয়ে একটি পোস্টে প্রকাশিত হয়, নির্বাচন কমিশন “প্রশিক্ষণের নামে” সাড়ে সাত কোটি টাকা অপচয় করেছে, কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা ছাড়া।
অর্থাৎ, এই খাতে ব্যয় হয়েছে জনগণের টাকা, কিন্তু তার বিনিময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী উন্নয়ন হয়েছে—তা কেউ জানে না। গণতন্ত্রের নামে যদি এমন অর্থ লুটপাট চলতে থাকে, তবে মানুষ ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে কেন আগ্রহী হবে?
✦ গেজেট বিলম্ব, হলফনামা গায়েব, তথ্যপ্রকাশে ঝুলে থাকা—স্বচ্ছতার সংকট
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের হলফনামা প্রকাশে দীর্ঘ বিলম্ব এবং ভোট কেন্দ্রের গেজেট প্রকাশে অলসতা—এইসব ছোট ছোট ঘটনা জুড়েই জন্ম নেয় বড় বড় অবিশ্বাস।
একটি স্বচ্ছ নির্বাচন কমিশন যেখানে প্রত্যেক তথ্য জনগণের কাছে সময়মতো প্রকাশ করবে, সেখানে গোপনীয়তা বা বিলম্ব স্বাভাবিকভাবেই সন্দেহ তৈরি করে।
✦ আশার আলো: নীতিমালায় পরিবর্তন, কিন্তু বাস্তবায়নে?
সব দিকেই কি অন্ধকার? না। কিছু ইতিবাচক দিকও আছে।
নতুন গেজেট অনুযায়ী ২০২৫ সালের ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনা নীতিমালায় ডিসি ও এসপি’র কমিটিকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থার দিকেই এক ধাপ এগিয়ে যাওয়া।
এছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নির্বাচনী সীমানা পুনর্বিন্যাস, জাতীয় ভোটার দিবসে স্লোগান ইত্যাদি কিছু উদ্যোগ ইসির সচেতনতা প্রদর্শনের ইঙ্গিত দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এগুলো কি যথেষ্ট?
✦ সমাধানের পথ: প্রযুক্তি, স্বচ্ছতা, ও বাস্তবায়নের রাজনৈতিক সদিচ্ছা
> কেবল আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, দরকার কঠোর প্রয়োগ। দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা, এবং আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার।
সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব:
১. ভোটার তালিকায় ডিজিটাল স্বচ্ছতা আনা হোক।
২. প্রতিটি ভোটারের অনুমোদন ও স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করা হোক।
৩. ইভিএম ব্যবহারে স্বচ্ছ ও তদারকিমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হোক।
৪. নিয়োগে সার্চ কমিটিতে রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজ ও মিডিয়ার প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
৫. প্রশিক্ষণ ও আর্থিক ব্যবস্থাপনায় নীতিমালা বাধ্যতামূলক করা হোক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের তদারকি অন্তর্ভুক্ত করা হোক।
✦ শেষ কথা:
সত্যিকার ‘নির্বাচন কমিশন’ না হলে, গণতন্ত্র কেবলই ‘ডেমো’
গণতন্ত্রের চালিকাশক্তি হচ্ছে জনগণের রায়। আর সেই রায় যে পাত্রে ঢেলে প্রকাশ করা হয়, তার নাম নির্বাচন কমিশন। সেই পাত্র যদি ছিদ্রপূর্ণ হয়, তাহলে গণতন্ত্রের রস বাঁচে না। কেবল লোক দেখানো নির্বাচন আর মিডিয়ায় ফলাফল ঘোষণার মাধ্যমে এক আধুনিক গণতন্ত্র গড়ে উঠতে পারে না।
আজ সময় এসেছে নির্বাচন কমিশনকে “আসলে স্বাধীন” করার। একে কাগজ থেকে বের করে বাস্তবের মাঠে আনার। জনগণের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে না পারলে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র চিরকালই থাকবে নিছক এক আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে।