বেশভুশা দেখলে যে কারো মনে হতে পারে তিনি একজন সৎ অফিসার। অথচ তিনি আপাদমস্তক অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত। ঘুষ ছাড়া কিছুই বুঝেননা তিনি। তার নেতিবাচক কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ রামুর শিক্ষক সমাজ।
যার কথা বলছি তিনি কক্সবাজারের রামু উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ। রামুতে যোগদান করার পর থেকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের যেন শেষ নেই। এদিকে সম্প্রতি রামুর ধেছুয়াপালং উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণির কাছ থেকে শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের ঘুষ গ্রহনের একটি ভিডিও ক্লিপস সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে।
ভিডিওতে দেখা যায়, অনেকক্ষন দর-কষাকষির এক পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ প্রধান শিক্ষক ওসমান গনির কাছ থেকে ঘুষের টাকা নিচ্ছেন।
এর আগে তিনি দেশের আরও কয়েকটি স্থানে একই পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের যেখানেই গেছেন, সেখানেই তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের তদন্তে বিষয়টি প্রমাণিত হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
প্রতিবেদকের হাতে আসা নূর মোহাম্মদের আগের তিন কর্মস্থলের কিছু নথি পর্যালোচনা করে মিলেছে এমন তথ্য। বর্তমান কর্মস্থলেও তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে বেসরকারি স্কুল ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্তি, শিক্ষকদের তালিকাভুক্তি, বেতনের স্কেল বৃদ্ধি, নামের ভুল সংশোধন, মাধ্যমিক পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনসহ নানা বিষয়ে বর্তমান কর্মস্থলে ঘুষ নেওয়ার সাতটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি লিখিত এবং ছয়টি মৌখিক পেয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
প্রতিবেদকের হাতে আসা ২০১৬ সালের ২৮ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি নোটিশে নূর মোহাম্মদকে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। এ ছাড়া একই বছর তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। রামুতে কর্মরত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ এর আগে রাঙামাটি পার্বত্য জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলায় মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিশাখা-১০ (মাধ্যমিক-১)-এর ১০৬৮ নম্বর স্মারক অনুযায়ী, ২০১৪ সালের জুলাই-ডিসেম্বর সেমিস্টারের উপবৃত্তি দিতে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে বিধিবহির্ভূতভাবে টাকা নেওয়া, ২০১৫ সালে বিনা মূল্যের বই বিতরণে বিভিন্ন স্কুল থেকে টাকা আদায়, খেদামারা উচ্চবিদ্যালয় পরিদর্শনের পর পরিদর্শন বই ফেরত আনার জন্য প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা গ্রহণের অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ তদন্তে রাঙামাটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সেই তদন্তে তৎকালীন বাঘাইছড়ি উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে সব অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছিল বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
এসব বিষয় উল্লেখ করে তাঁকে কেন চাকরিচ্যুত করা হবে না, এ মর্মে কারণ দর্শাতে নোটিশ জারি করা হয়েছিল। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫-এর বিধি ৩-এর উপবিধি (বি) ও (ডি) অনুযায়ী তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে সেই নোটিশের আর অগ্রগতি নেই, পরবর্তী সময় তাঁকে রামুতে পদায়ন করা হয়।
নিজের বেতন বাড়াতে ঘুষ দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ধেছুয়াপালং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণি। এ ব্যাপারে জেলা শিক্ষা অফিসে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন বলে জানান।
এদিকে প্রধান শিক্ষক ওসমান গণির কাছ থেকে ঘুষ গ্রহনের ঘটনা সামনে আসার পর উপজেলার একাধিক বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসার শিক্ষকের কাছ থেকে বদলি, বেতন বৃদ্ধি, এমপিওভুক্তি, নাম সংশোধনসহ নানা কারণে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলার মেরংলোয়া রাহমানিয়া আলিম মাদ্রাসার একাধিক শিক্ষক অভিযোগ করে জানান, উচ্চতর স্কেলের জন্য ছয় জন শিক্ষকের কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মচারির নিয়োগ লিস্টে স্বাক্ষরের জন্য ২০ হাজার এবং তাদের এমপিও’র জন্য নিয়েছেন ৪৫ হাজার টাকা। বিদ্যলয়ের আরেক শিক্ষিকার কাছ থেকে এমপিওভুক্তির জন্য ১৫ হাজার টাকা ঘুষ নিয়েছেন শিক্ষা কর্মকর্তা।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে রামু উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের মোবাইল ফোনে গত ২দিন ধরে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জানতে চাইলে রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা বলেন লিখিত অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করবেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, প্রায় এক বছর ধরে রামুতে দায়িত্ব পালন করছেন নূর মোহাম্মদ। এর আগে সাতকানিয়া উপজেলায়ও একই ঘুষকাণ্ডে জড়ান তিনি। নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার একাধিক অভিযোগ পেয়েছেন জানিয়ে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাছির উদ্দিন বলেন, ‘ধেছুয়াপালং উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওসমান গণি ঘুষ দাবির বিষয়ে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। রামুর আরও পাঁচ-ছয়জন শিক্ষক মৌখিকভাবে একই অভিযোগ করেছেন। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে জানানো হবে।’
