Sunday, 27 July 2025

ডাক ও টেলিযোগাযোগের সিরাজগঞ্জে ব্যয় ১২ কোটি, সুফল ‘ছিটেফোঁটা’


সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি :

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ইন্টারনেটভিত্তিক ১৮টি সেবা পৌঁছে দিতে সিরাজগঞ্জে দুটি উপবিভাগে ১৯২টি পোস্ট ই-সেন্টার চালু করেছিল ডাক বিভাগ। বর্তমানে যার ১৫০টিই বন্ধ রয়েছে। অথচ এতে ব্যয় হয়েছে ১২ কোটি ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা।



ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পতিত সরকারের ‌‘রূপকল্প ২০২১’ বাস্তবায়নে ২০১২ সালে ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ নামে প্রকল্পটি হাতে নেয় সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ। এর আওতায় ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে সাড়ে আট হাজার উদ্যোক্তা নিয়োগের মাধ্যমে পোস্ট ই-সেন্টার চালু করা হয়। পরবর্তী এক দফা মেয়াদ বাড়ানোর পর ২০১৭ সালের ৩০ জুন প্রকল্পটি কাগজে-কলমে শেষ হয়।



এই প্রকল্পের অধীনে সিরাজগঞ্জে ১৯২টি পোস্ট ই-সেন্টার রয়েছে। যার উদ্দেশ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেওয়া, রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে সহায়তা, ডাকঘরকে ডিজিটালাইজড, কৃষি স্বাস্থ্য ও সেবা বিষয়ে তথ্য সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক কমার্শিয়াল পোস্টাল সার্ভিসের সূচনা, আইটিভিত্তিক পল্লি উদ্যোক্তা তৈরি, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার এবং পোস্টাল ক্যাশ কার্ড সার্ভিসের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। কিন্তু চালুর কিছুদিন যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়ে বেশিরভাগ সেন্টারের কার্যক্রম। এমনকি পোস্ট-ই-সেন্টারের সেবা সম্পর্কেই জানেন না অনেকে। প্রকল্পটি শেষ হলেও ই-সেন্টারগুলো চালু থাকার কথা।



“ডাক বিভাগের ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে শর্তসাপেক্ষে বেশ কিছু সরঞ্জাম নিয়েছিলাম। শর্ত পূরণে আয়ের ১০ শতাংশ শাখা পোস্ট মাস্টার ও ১০ শতাংশ সরকারকে কয়েক মাস প্রদানও করি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের দেওয়া ল্যাপটপ ও প্রিন্টার নষ্ট হয়ে যায়। সেটা মেরামতেরও চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাজারে এসব সরঞ্জামের যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় মেরামত করা যায়নি। পরে ডাক বিভাগের পরিদর্শক অফিসে সরঞ্জামগুলো ফেরত দিয়েছি।”



সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এসব সেন্টারে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিনামূল্যে তিনটি ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, মডেম, সিম কার্ড, মাউস-কিবোর্ড প্যাকেজ, হেডফোন, মাল্টিপ্লাস এমকে সকেট বোর্ড, পিওএস মেশিনসহ ১৯ রকম সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। যার মূল্য ধরা হয় ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিটি ই-সেন্টার থেকে যে আয় হবে, তার ১০ শতাংশ পাবেন সংশ্লিষ্ট পোস্ট মাস্টার, সরকার ১০ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তার।



তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পের সরবরাহ করা সরঞ্জামের মূল্য কাগজে-কলমে বেশি দেখানো হলেও অতি নিম্নমানের হওয়ায় উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে ছিটেফোঁটা। মঙ্গল ও বুধবার (২২ ও ২৩ জুলাই) সরেজমিন পোস্ট ই-সেন্টার পরিদর্শনে দেখা মেলেনি কোনো দায়িত্বরত কর্মকর্তা কিংবা কোনো কর্মচারীর। ই-পোস্ট সেন্টার যেন শুধু নামেই আছে। যেখানে সাইনবোর্ড আছে সেখানে যেসব উপকরণ থাকার কথা, প্রশিক্ষণ হওয়ার কথা; সেগুলোর কিছুই নেই। দু-একটি পরিচালিত হয় স্থানীয় বাজারে।



কথা হয় কাজিপুর উপজেলার চালিতাডাঙ্গা ইউনিয়নের ই-পোস্ট সেন্টারের উদ্যোক্তা নিলয় কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, “ডাক বিভাগের ‘পোস্ট ই-সেন্টার ফর রুরাল কমিউনিটি’ শীর্ষক প্রকল্পের অধীনে শর্তসাপেক্ষে বেশ কিছু সরঞ্জাম নিয়েছিলাম। শর্ত পূরণে আয়ের ১০ শতাংশ শাখা পোস্ট মাস্টার ও ১০ শতাংশ সরকারকে কয়েক মাস প্রদানও করি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে প্রকল্পের দেওয়া ল্যাপটপ ও প্রিন্টার নষ্ট হয়ে যায়। সেটা মেরামতেরও চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাজারে এসব সরঞ্জামের যন্ত্রাংশ না পাওয়ায় মেরামত করা যায়নি। পরে ডাক বিভাগের পরিদর্শক অফিসে সরঞ্জামগুলো ফেরত দিয়েছি।”



সিরাজগঞ্জ পৌর শহরের বাজার স্টেশনে ই-সেন্টারের সেবা দিতে কম্পিউটার নিয়ে বসেছিলেন উদ্যোক্তা রুবেল সরকার। দেখা গেলো কোনো সেবাগ্রহীতা নেই। রুবেল সরকার বলেন, ‘এখানে খরচ অনেক কম। তবুও মানুষ কম আসে। প্রকল্প থেকে সরবরাহ করা তার ল্যাপটপ ও প্রিন্টার নষ্ট হয়ে গেছে। তাই নিজস্ব কম্পিউটার ও প্রিন্টার দিয়েই সেবা দিচ্ছি।’



এসব সেন্টারে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিনামূল্যে তিনটি ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, মডেম, সিম কার্ড, মাউস-কিবোর্ড প্যাকেজ, হেডফোন, মাল্টিপ্লাস এমকে সকেট বোর্ড, পিওএস মেশিনসহ ১৯ রকম সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়। যার মূল্য ধরা হয় ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা। প্রতিটি ই-সেন্টার থেকে যে আয় হবে, তার ১০ শতাংশ পাবেন সংশ্লিষ্ট পোস্ট মাস্টার, সরকার ১০ শতাংশ এবং ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তার।



শাহজাদপুর ও সদর উপবিভাগের (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) পোস্ট অফিস পরিদর্শক আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘প্রতিটি ই-সেন্টারে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিনামূল্যে তিনটি ল্যাপটপ, প্রিন্টার, স্ক্যানার, মডেম, সিম কার্ড, মাউস-কিবোর্ড প্যাকেজ, হেডফোন, মাল্টিপ্লাস এমকে সকেট বোর্ড, পিওএস মেশিনসহ ১৯ রকম সরঞ্জাম দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ই-সেন্টার থেকে যে আয় হবে, তার ১০ শতাংশ পাবেন সংশ্নিষ্ট পোস্ট মাস্টার, সরকার ১০ শতাংশ ও ৮০ শতাংশ উদ্যোক্তার। কিন্তু ৮০ শতাংশ সরঞ্জার নষ্ট হওয়ায় উদ্যোক্তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন এই সেবা কার্যক্রম থেকে।



শুধু তাই নয়, কোনো নির্দেশনা না থাকায় সরকারি নষ্ট সরঞ্জামগুলো উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করাও যাচ্ছে না। উদ্যোক্তাদের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে পরিদর্শক আব্দুল মোতালেব বলেন, ‘প্রকল্পটি নেওয়ার ক্ষেত্রে সঠিক পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন করা হয়নি। বাস্তবায়নের পর যথাযথ মনিটরিংয়ের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। যে কারণে লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছে।’



এ বিষয়ে পাবনা ডেপুটি পোস্ট মাস্টার জেনারেল নাঈমুর রহমান বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নেওয়ার আগে প্রকল্পটি শেষ হয়েছে। এজন্য আমি তেমন কিছু বলতে পারবো না। তবে প্রকল্পটি যখন নেওয়া হয়েছিল তখন ডাক বিভাগের জনবল, তাদের সক্ষমতা ও কর্মদক্ষতার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। যে কারণে প্রকল্প শেষ হওয়ার পর লোকবলের অভাবে অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। সেন্টার আর চালু করা যায়নি।’



তিনি জানান, ৫৪০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ব্যয়ে সারাদেশে সাড়ে আট হাজার উদ্যোক্তার মাধ্যমে পোস্ট ই-সেন্টার চালু করা হয়। এতে প্রত্যেক সেন্টারে ব্যয় হয়েছিল ছয় লাখ ৩৬ হাজার ৪০০ টাকা। সে হিসেবে সিরাজগঞ্জে ১৯২টি পোস্ট ই-সেন্টারে ১২ কোটি ২১ লাখ ৮৮ হাজার ৮০০ টাকা ব্যয় হয়েছে।