জহির শাহ :
২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশের রাজপথে যে ঝড় উঠেছিল, তা শুধু একটি আন্দোলন ছিল না—তা ছিল একটি জাতির জাগরণ, একটি বিপ্লব, যা ইতিহাসের পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে। এই গণঅভ্যুত্থান, যা “জুলাই বিপ্লব” নামে অমর হয়ে আছে, শুরু হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির সংস্কারের দাবিতে, কিন্তু ক্রমে তা আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনতার প্রচণ্ড ক্রোধের প্রতীকে পরিণত হয়।
এই বিপ্লবের রক্তিম পথ ধরে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে, তিনি ৫ আগস্ট ২০২৪ ভারতে পালিয়ে যান, এবং বাংলাদেশ নতুন এক যুগের সূচনা করে। এই আন্দোলনকে অনেকে বাংলাদেশের “দ্বিতীয় স্বাধীনতা” হিসেবে অভিহিত করেছেন, কারণ এটি কেবল কোটা সংস্কারের লড়াই ছিল না—এটি ছিল দুর্নীতি, অর্থপাচার, মাদক, চাঁদাবাজি, এবং সর্বোপরি, একটি স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে জনতার অটল প্রতিরোধের গল্প। এই গল্প লেখা হয়েছে তরুণদের রক্তে, শিশুদের কান্নায়, এবং একটি জাতির অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে।
এই গণঅভ্যুত্থানের বীজ বপন হয়েছিল ২০২৪ সালের ৫ জুন, যখন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০১৮ সালের সরকারি পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করে। সেই পরিপত্রে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য ৩০% কোটা, নারীদের জন্য ১০%, এবং জেলা কোটা ১০% বাতিল করা হয়েছিল। হাইকোর্টের এই রায় কোটা পুনর্বহালের সম্ভাবনা তৈরি করে, যা শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্ম দেয়। তারা মেধাভিত্তিক নিয়োগের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে প্রথম সমাবেশের মাধ্যমে শুরু হয় “বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন” নামক সংগঠনের নেতৃত্বে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ। কিন্তু সরকারের কঠোর দমননীতি, পুলিশ ও ছাত্রলীগের হামলা, এবং পরবর্তীতে কারফিউ ও ইন্টারনেট বন্ধের মতো পদক্ষেপ এই আন্দোলনকে একটি জাতীয় গণজাগরণে রূপ দেয়।
আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা “বাংলা ব্লকেড” নামে দেশব্যাপী অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই কর্মসূচি ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ, এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা আন্দোলনকারীদের ওপর নির্মম হামলা চালায়। ১৬ জুলাই রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন, যিনি এই আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে পরিচিতি পান। তার মৃত্যু জাতির বিবেককে নাড়া দেয়। ১৮ জুলাই চট্টগ্রামে মীর মুগ্ধ নামে আরেকজন শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান। এই দুই নাম আন্দোলনের প্রতীকে পরিণত হয়, যারা তরুণদের রক্ত দিয়ে বিপ্লবের পথ রাঙিয়েছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৬ জুলাই থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত এই আন্দোলনে কমপক্ষে ৬৫০ জন নিহত হন, যদিও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিবেদন দাবি করে, মৃতের সংখ্যা ১,৫৮১, যার মধ্যে ১২৭ জন শিশু। এই হত্যাকাণ্ড, যা “জুলাই গণহত্যা” নামে পরিচিত, বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায়।
সরকারের দমননীতি আন্দোলনকে দমাতে ব্যর্থ হলে ছাত্ররা তাদের দাবি আরও কঠোর করে। ৩ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম একটি “এক দফা” দাবি ঘোষণা করেন—শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার নিঃশর্ত পদত্যাগ। এই ঘোষণা আন্দোলনকে কোটা সংস্কারের সীমানা ছাড়িয়ে সরকার পতনের দিকে নিয়ে যায়। “দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ” এবং “স্টেপ ডাউন হাসিনা” স্লোগানে রাজপথ কেঁপে ওঠে। ৫ আগস্ট “মার্চ টু ঢাকা” কর্মসূচিতে লাখো মানুষ গণভবনের দিকে এগিয়ে যায়। পুলিশের ব্যারিকেড, টিয়ারগ্যাস, এবং গুলি সত্ত্বেও জনতার ঢল থামানো যায়নি। সেই দিন দুপুরে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জাতির উদ্দেশে ভাষণে শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বিমানে ভারতে পালিয়ে যান, যা তিনি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, “শেখ হাসিনা পালায় না”।
এই বিপ্লবের পটভূমিতে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের দুর্নীতি, অর্থপাচার, এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ প্রকাশ পায়। আওয়ামী লীগের শাসনামলে কানাডায় “বেগমপাড়া” নামে অর্থপাচারের অভিযোগ ওঠে, যেখানে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের ফলে দেশের রিজার্ভে ঘাটতি দেখা দেয়। এই অর্থনৈতিক সংকট মুদ্রাস্ফীতি বাড়ায়, জ্বালানি সংকট তৈরি করে, এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তোলে। আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মাদক কারবারের অভিযোগও ছিল আন্দোলনের অন্যতম কারণ। জুলাই বিপ্লবের পর রাজশাহীতে ৩,০০০ পিস ইয়াবাসহ মাদক কারবারি গ্রেপ্তারের মতো ঘটনা আইনশৃঙ্খলার উন্নতির প্রচেষ্টাকে তুলে ধরে।
৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল শান্তি-শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন, এবং অবাধ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। ইউনূস ঢাকায় ফিরে সাংবাদিকদের বলেন, “আমার প্রথম কাজ শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা।” এই সরকার দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় এবং সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। তবে, আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহল থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন সৃষ্টি করে।
জুলাই বিপ্লব বাংলাদেশের জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে অমলিন ছাপ রেখেছে। “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার রাজাকার”, “আমার ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেব না”, এবং “শোনো মহাজন, আমরা অনেক জন” স্লোগানগুলো জনতার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। শূন্য ব্যান্ডের “শোনো মহাজন” গানটি ইউটিউবে ৬ মিলিয়নের বেশি ভিউ পায়, যা আন্দোলনের প্রতীকী সুর হয়ে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে লাল ফ্রেমের প্রোফাইল ছবি, “নাটক কম করো পিও” জাতীয় পোস্ট, এবং গ্রাফিতি যেমন “ইনকিলাব জিন্দাবাদ” জনগণের সমর্থনকে আরও জোরদার করে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন “জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র” ঘোষণা করে, যেখানে ১৯৭২ সালের সংবিধান বাতিলের দাবি ওঠে, যা বিতর্কের জন্ম দেয়।
এই বিপ্লবের পেছনে ছিল তরুণদের অদম্য সাহস, সাধারণ মানুষের ঐক্য, এবং গণতন্ত্রের প্রতি অটল বিশ্বাস। আন্দোলন প্রাথমিকভাবে অরাজনৈতিক ছিল, তবে পরবর্তীতে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো দলগুলো এর কৃতিত্ব দাবি করে। তবু, এই বিপ্লব ছিল ছাত্র ও জনতার, যারা রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে, বাংলাদেশকে একটি নতুন পথ দেখিয়েছে। জুলাই বিপ্লব শুধু একটি ঘটনা নয়—এটি একটি জীবন্ত অভিজ্ঞতা, যেখানে প্রতিটি শহীদের রক্ত জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলেছে। এই গাথা প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল ধ্বনিত হবে, যেন রাজপথের প্রতিটি পদক্ষেপ বলছে—আমরা হারিনি, আমরা জিতেছি।