জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
একটা মুঠো চাল যেন একটা পরিবারের স্বপ্নের আলো—কিন্তু নাসিরনগরের মহাখালপাড়ায় সেই আলো নিভিয়ে দিয়েছে কয়েকজন লোভী হাত। সোমবার রাত সাড়ে ১১টায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের গোপন অভিযানে দুটি দোকান থেকে জব্দ হয়েছে সরকারি খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ৭,৫০০ কেজি চাল, যা ছিল হাজার হাজার গরিবের মুখের গ্রাস। সরকারি সিলমোহরযুক্ত ২০০ বস্তা—১০০টা ৫০ কেজি করে, আর ১০০টা ২৫ কেজি করে—প্লাস ১৫০টা খালি বস্তা, সব মিলিয়ে এ যেন একটা অদৃশ্য চুরির গুপ্তধন উন্মোচিত। চাল সরানোর চেষ্টায় ধরা পড়ে আটক হয়েছে দুই শ্রমিক: শাহকামাল মিয়া (৪০) আর জুয়েল মিয়া (৩৮), দুজনেই বুড়িশ্বর ইউনিয়নের আশুরাইল গ্রামের সাধারণ মানুষ। কিন্তু প্রশ্ন জ্বলজ্বল করে ওঠে—এই বিশাল চালের পাহাড় কীভাবে পৌঁছালো দোকানদার মোতাহার মিয়া আর রহমত আলীর গুদামে? এটা কি শুধু শ্রমিকের ভুল, নাকি একটা বড় চক্রের ছোট অংশ?
নাসিরনগরে প্রায় ১১ হাজার হতদরিদ্র পরিবারের জন্য বিশেষ কার্ড দিয়ে চাল বিতরণের প্রস্তুতি চলছিল—যাদের সংসারে প্রতিদিনের যুদ্ধ ক্ষুধার সঙ্গে। বিতরণ শুরুর আগেই এই লুটপাট উন্মোচিত হলে স্থানীয় মানুষের বুকে আগুন জ্বলে উঠেছে: কত পরিবার আজ খালি থালায় চেয়ে কাঁদছে? খাদ্যগুদামের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মনিরুল ইসলাম বলছেন, “ডিলাররা নিয়মিত চাল নিয়ে যায়, কিন্তু এগুলো কীভাবে দোকানে গেল, তা তারাই বলতে পারবে।” এ কথায় কি দায় এড়ানোর ছায়া লুকিয়ে আছে, নাকি সত্যিই ডিলারদের হাতে অন্ধকারের চাবি? উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেনের নীরবতা তো আরও গভীর প্রশ্ন তোলে—তিনি বললেন, “এখনই কিছু বলতে পারছি না।” এই নীরবতা কি গরিবের কান্নাকে আরও গভীর করে না?
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীনা নাছরিনের নেতৃত্বে স্থানীয় সূত্রের গোপন খবরের ভিত্তিতে চালানো এই অভিযানে জনমনে একফোঁটা আশা জ্বলে উঠেছে। তিনি বলছেন, “চাল আর খালি বস্তা জব্দ করা হয়েছে, ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” কিন্তু ব্যবস্থা বলতে কী—শুধু দুই শ্রমিককে আটক করে শেষ? মূল অপরাধী, যারা এই চালকে কালোবাজারের দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, তাদের ধরার ক্ষমতা কি প্রশাসনের আছে? এই চালের বাজারমূল্য হাজার হাজার টাকা—কিন্তু গরিবের কাছে এটা ছিল জীবনের ভরসা। স্থানীয় সূত্র বলছে, খাদ্যগুদাম থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে এই দোকানগুলো, তাহলে কি চোখ বন্ধ করে ছিল সবাই?
এই ঘটনা শুধু নাসিরনগরের নয়, এ যেন সারা দেশের দরিদ্র মানুষের অধিকারের উপর ছুরির আঘাত। কতবার এমন লুট হয়েছে, যা আলোয় আসেনি? প্রতিটি বস্তা চাল যেন একেকটা শিশুর ক্ষুধার্ত চোখের জল—এগুলো কালোবাজারে গিয়ে বিক্রি হলে কত পরিবারের স্বপ্ন ভেঙে যেত? প্রশাসন এখন জনগণের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে: মূল চোরদের ধরবে, নাকি আবারও নীরবতার পর্দায় ঢেকে দেবে? এই জব্দ শুধু চাল ফিরিয়ে আনেনি, এ যেন সত্যের পথে একটা ছোট বিপ্লবের শুরু—কিন্তু সেই আগুন জ্বালিয়ে রাখার দায়িত্ব কার? যদি বিচার না হয়, তাহলে গরিবের বিশ্বাস আবারও মাটিতে মিশে যাবে। জনমন বলছে: এবার সময় সত্যের পক্ষে দাঁড়ানোর।
