দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। মানুষের স্বপ্নপূরণে জীবন উৎসর্গ করব: পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো বিএনপি কর্মী জাসাম - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Saturday, 24 February 2024

মানুষের স্বপ্নপূরণে জীবন উৎসর্গ করব: পুলিশের গুলিতে চোখ হারানো বিএনপি কর্মী জাসাম


রাজনীতি প্রতিবেদক :
রাতের আঁধারে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, স্বপ্নগুলো তখন জেগে ওঠে তার চোখে। যদিও চোখে এখন আর আগের মতো দেখতে পায় না সে। চোখের দুই কূল ছাপিয়ে ঝরে পড়ে গুমোট কান্না; আর বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে কাটে নির্ঘুম রাত। ভোর বেলা ফের হাসপাতালের বারান্দায় বারান্দায়। এভাবেই কাটছে জাসামের নিত্যদিনের যাপিত জীবন। 


বাবা হারুন অর রশিদের স্বপ্ন ছিলো জাসাম বড় হয়ে লেখাপড়া শিখে সরকারি বড় চাকরি করবে। দরিদ্র কৃষক বাবার সংসারে সুখের আলো আসবে। সবই এখন বিবর্ণ। আঁধারে ঢেকে গেছে স্বপ্নের সোনালি আলো। 


নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার দরিদ্র কৃষক হারুন অর রশিদের তিন সন্তানের মধ্যে আশরাফুল ইসলাম জাসাম সবার ছোট। বড় সন্তান শফিউল আলম ডালিম যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরে চাকরি পান। কিন্তু ছাত্রাবস্থায় বিএনপির রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকায় সে চাকরি চলে যায় তার। মেজো ভাই আব্দুল আলীম রাজধানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। আব্দুল আলীম আর অশিতিপর কৃষক বাবা হারুনের আয়েই চলছে জাসামদের নয় সদস্যের সংসার। 


পারিবারিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় ২০১৭ সালের পর থেকে হারুন অর রশিদের তিন ছেলে বাড়িতে থাকতে পারেন না। টেনেটুনে কোনোমতে জীবন চলছিল তাদের। পড়াশোনা শেষ করে তিন ছেলে সংসারের হাল ধরবে, এ স্বপ্নে বিভোর ছিলেন জাসামের কৃষক বাবা হারুন। 


কিন্তু একে একে মরে গেল স্বপ্নেরা। ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকার নয়পল্টনে বিএনপির সমাবেশে পুলিশের গুলিতে একটি চোখ হারিয়ে ফেলে কেন্দুয়া সরকারি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত আশরাফুল উসলাম জাসাম। চোখের আলো হারিয়ে, আধারে ঢেকে গেছে জাসামের জীবন। মিডিয়ার কাছে কিশোর জাসাম তার জীবনের নির্মমতার কথা খোলামেলা ভাবেই বলেছেন।।


প্রশ্ন: কীভাবে চোখে গুলিবিদ্ধ হলেন? 
জাসাম: ২৮ অক্টোবর দুপুরের দিকে কাররাইলের নাইটিঙ্গেল মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমার এলাকা থেকে বিএনপির অনেক নেতারা এসেছিলেন। তাদের সাথে আমিও ছিলাম। হঠাৎই মানুষের দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। যে যেভাবে পারছে ছুটছে। আমিও দৌড় দিলাম। এরই মধ্যে সামনে থেকে পুলিশ গুলি ছুড়ল। হাজার হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যে আচমকা গুলি। আমরা বুঝে ওঠার আগেই আমার মাথায়, বুকে-মুখে গুলি লাগল। মাটিতে পড়ে গেলাম। কয়েকজন আমাকে ধরাধরি করে নয়াপল্টন বিএনপি অফিসের দিকে নিয়ে গেল। কিন্তু ওদিক দিয়েও গুলি চলছে। উপায়ান্তর না পেয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো নয়াপল্টনের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা হলো। শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেকগুলো গুলি বের করা হলো। চেখের ব্যথায় আমি অজ্ঞান প্রায়। পরীক্ষা করে ডাক্তার দেখলেন আমার বাম চেখের ভেতরেও গুলি লেগেছে। 

প্রশ্ন:  চোখের গুলি বের করেনি কেন?  
জাসাম: ওই হাসপাতালে চোখের গুলি বের করা গেল না। আমাকে পাঠানো হলো শান্তিনগর মোড়ের বাংলাদেশ আই হাসপাতালে। সেখানে পরীক্ষার পর আমাকে ভর্তি হরা হলো ধানমন্ডির বাংলাদেশ আই হাসপাতালে। ঘটনার চার দিন পর সেখানে আমার চোখের অপারেশন করানো হলো। চোখের মনি থেকে গুলি বের করা হলো। 

প্রশ্ন:  আপনি বলছিলেন, আপনার বাবা দরিদ্র কৃষক; চিকিৎসা ব্যায় বহন করলো কে? 
জাসাম: শরীরের অন্যান্য গুলি এবং আঘাতের চিকিৎসা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালেই হয়েছে। সেটা দলের পক্ষ থেকে বহন করা হয়েছে। কে দিয়েছে আমি জানি না। তবে চোখের চিকিৎসার জন্য অপারেশনের দিন প্রথমে আমার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা নেয়া হয়েছিল। এই টাকা আমার পরিবারের পক্ষ থেকেই দেয়া হয়েছে। এরপর খবর পেয়ে ধানমন্ডির হাসপাতালের বিল ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার ভাই দিয়েছেন। সেখানে কত টাকা বিল ছিল আমি জানি না। 

প্রশ্ন: ওষুধপথ্য কীভাবে চললো? 
জাসাম: ওষুধ আমার বাবা, ভাই এরাই চালাচ্ছেন। আমি গুলশান থানা ছাত্রদলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক; কিন্তু ছাত্রদলের তিতুমীর কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আকরাম ভাই ছাড়া অন্য কেউ খবর নেননি। এখনো পরিবারই আমার চিকিৎসা চালাচ্ছে। অবশ্য সঠিক চিকিৎসা চালাতে পারছি না। 

প্রশ্ন:  এখন চোখের কী অবস্থা? 
জাসাম: চোখের ভেতরে গুলি লেগেছিল। বাম চোখে একেবারেই দেখতে পাই না। চিকিৎসকরা বলছিলেন, ভেতরে ইনফেকশন হয়নি। আমি দেখতে পাব। কিন্তু এখনো আমি দেখছি না। সবাই বলছেন, দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসা নিলে আমি হয়তো দেখতে পাব।

প্রশ্ন:  এখন কোন কোন ধরনের সমস্যা হচ্ছে? 
জাসাম: আমি জন্মান্ধ না। হঠাৎই আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে এমন হয়েছে। আমি তো ছোটবেলা থেকে এতে অভ্যস্ত না। এখন আমার হাঁটতে-চলতে সমস্যা হয়। বিশেষ করে আমি বাম পাশ একেবারেই দেখি না। হাঁটার সময় সমান রাস্তায়ও হোঁচট খাই, পড়ে যাই। লিখতে পারি না। এক চোখ দিয়ে কলম সঠিক যায়গায় ধরতে পারি না। পড়তে গেলেও এক দিক কাত হয়ে পড়তে পারি। এক চোখে বেশি চাপ পড়ায় কিছুক্ষণ পর ডান চোখও ব্যাথা করে। 

প্রশ্ন:  তখন কী মন খারাপ হয়? নিজের ওপর রাগ হয়? 
জাসাম: রাগ হয় না। তবে, মাঝে মধ্যেই ভীষণ মন খারাপ হয়। মাত্র কিছুদিন আগেও আমি অনেক স্বপ্ন দেখতাম। জীবনে অনেক কিছু করার চিন্তা করতাম। কিন্তু চোখের আলো হারিয়েছি, মনে হয় জীবনের আলোও হয়তো হারাচ্ছে। একটা সময় বাবা-মা কান্না করতো। কিন্তু তারাও এখন আর কাঁদেন না। 

প্রশ্ন:  বাবা-মা, বড় ভাইয়েরা কী আপনাকে বোঝা মনে করছে? 
জাসাম: না, ঠিক তেমন না। তারাও কষ্ট পাচ্ছেন। তাদের সামর্থ্য নেই। কিন্তু তারাও সবাই চ্ষ্টো করেন, আমার সঠিক উন্নত চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেই পরিমাণ সামর্থ্য আমার পরিবারের নেই। ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি, আমার বাবা কৃষক দলের এক সময় ওয়ার্ডের সভাপতি ছিলেন। সে কারণে গ্রামের ক্ষমতাসীন দলের লোকেরা আমাদের পরিবারকে নানাভাবে হয়রানি করছে। আমার বাবা ভাইয়েরা নিঃস্ব হয়ে গেছে। তাদেরই বা কী করার আছে। এখন আমার বাবা-মা বলেন, দলের জন্য যেহেতু চোখ খুইয়েছ, দলের জন্য প্রয়োজনে জীবন দিয়ে দাও। আমি (জাসামের বাবা) ভাবব আমার তিন ছেলের মধ্যে দুই ছেলে মরে গেছে। খেয়ে না খেয়ে তারাই আমাকে আগলে রাখছে। 

প্রশ্ন:  ছোটবেলা থেকেই কী আপনি রাজনীতি করছেন? 
জাসাম: না, আমার পরিবার বিএনপির রাজনীতি করতে দেখেছি। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমি বড় ভাই, বাবার সাথে বিএনপির মিছিলে গিয়েছিলাম। সে কারণে আমি ওই বছর এসএসসি পরীক্ষা দিতে পারিনি। আমাকে এলাকার আওয়ামী লীগের লোকেরা বাড়িতে থাকতে দেয়নি। বড় ভাইদের সাথে আমিও পালিয়ে ছিলাম। তাই পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরের বছর এসএসসি পাশ করে কেন্দুয়া সরকারি কলেজে ভর্তী হই। ২০২১ সালের পর থেকে আমরা তিন ভাই-ই বাড়ির বাইরে। এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষে উঠলেও আমি পরীক্ষা দিতে পারছি না। বাড়ি যেতে পারছি না। ঢাকায়ই থাকছি। দীর্ঘ দিন গুলশানে গুদারাঘাটে ছিলাম। চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সেখানেও থাকতে পারছি না। এখন আমি আর আমার মেজো ভাই মিরপুর এলাকায় থাকছি। 

প্রশ্ন:  চিকিৎসা চলছে কীভাবে? 
জাসাম: আমার বাম চোখের অপারেশনের সময়, চোখের ভেতরে এক ধরনের অয়েল দিয়ে দেয়া হয়েছে। তিন মাস পর আবার অপারেশন করিয়ে বের করার কথা। কিন্তু ভয়ে আমি এখনো বের হতে পারছি না। আর প্রতি সপ্তাহে তিন দিন নিয়মিত ফলোআপ করাতে হচ্ছে। আমি তো স্বাভাবিকভাবে এখনো চলতে পারছি না। বাসে উঠতে পারি না। চোখে ধূলাবালি লাগলে ব্যথা হয়। তাই বিশেষ ব্যবস্থায় চলাফেরা করতে হয়। সেখানেও যাতায়াতে অনেক টাকা খরচ হচ্ছে। মাসে অন্তত গড়ে ৩-৪ হাজার টাকার ওষুধ লাগে। কোনোমতে বিভিন্নজনের কাছ থেকে নিয়ে চিকিৎসা চালাচ্ছি। 

প্রশ্ন:  ডাক্তাররা কী বরছে? 
জাসাম: ডাক্তাররা বলছে, বিদেশে উন্নত চিকিৎসা করালে আমি চোখে দেখতে পাব। আমার সেই সামর্থ্য নেই। যদি কেউ এগিয়ে আসে, হয়তো আমি আবারো চোখের আলো ফিরে পাব। না হয়, এভাবেই বাকি জীবন কাটাবো। মেনে নিয়েই খুশি থাকতে হবে। কী আর করব। 

প্রশ্ন:  মন খারাপ হয়? 
জাসাম: মানুষের মধ্যে থাকলে হয় না। দলীয় কর্মসূচিতে থাকলে চোখ নেই, তা মনেই থাকে না। কিন্তু রাতে বা যখন একা থাকি, তখন খুব খারাপ লাগে। আর ওই ঘটনার পর থেকে আমি টানা দেড় মাস ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই, মনে হতো আমাকে কেউ গুলি করছে। আমার অন্য চোখেও গুলি করছে। ভীষণ কষ্টে ছিলাম। এখন ঘুম হয়। কিন্তু একা হলে মনে হয়, বাবা-মায়ের জন্য কিছু করতে পারলাম না। আশি বছরের বৃদ্ধ বাবার কাছে আবারো বোঝা হয়ে গেলাম। এর আগেও ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টনে বিএনপি অফিসে পুলিশের তাণ্ডবে আমি গুলিবিদ্ধ হই। সেই গুলি এখনো আমার পায়ে রয়ে গেছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকবার পুলিশের লাঠিপোট খেয়েছি। কখনো মন খারাপ হয়নি। কিন্তু এবার চোখ হারিয়ে খারাপ লাগে। কষ্ট পাই। 

প্রশ্ন:  জীবন নিয়ে পরিকল্পনা কি? 
জাসাম: জীবন নিয়ে একসময় অনেক পরিকল্পনা ছিল। বাবার স্বপ্ন ছিলো আমরা তিন ভাই লেখাপড়া শিখে পরিবারে সুখ ফেরাব। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের নির্যাতন-নিপীড়নে, সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন যতদিন বাঁচব, লড়াই করে বাঁচতে চাই। এক চোখই যথেষ্ট অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। হয়তো বাবার স্বপ্নপূরণ করতে পারলাম না। কিন্তু মানুষের জন্য লড়তে চাই। মানুষের স্বপ্নপূরণে জীবনটা উৎসর্গ করব। 

প্রশ্ন:  আপনাকে ধন্যবাদ। 
জাসাম: আমার মতো হাজারো মানুষের দূঃখ আছে। হারানোর কষ্ট আছে। সেগুলো তুলে ধরে গণতন্ত্রের এ লড়াইয়ে বাংলা আউটলুক সহযোদ্ধা হবে এই প্রত্যাশা করি। বাংলা আউটলুককে ধন্যবাদ।