দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া—সুরের পবিত্র তীর্থ, দক্ষিণ এশিয়ার সংগীত মহাকাব্য - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Wednesday, 23 July 2025

ব্রাহ্মণবাড়িয়া—সুরের পবিত্র তীর্থ, দক্ষিণ এশিয়ার সংগীত মহাকাব্য


জহির শাহ্ ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

প্রস্তাবনা: সুরের নগরীর আহ্বান

ব্রাহ্মণবাড়িয়া—এ নামটি শুনলে প্রথমে চোখে ভেসে ওঠে সীমান্তের কাছাকাছি এক জীবন্ত শহর: ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ছুটন্ত যানবাহনের গুঞ্জন, আখাউড়ার রেলপথে ট্রেনের শিস, আর বাজারের ব্যস্ততায় হাকারদের কোলাহল। 


কিন্তু এই শহরের গভীরে লুকিয়ে আছে এক অলৌকিক সুরের সাম্রাজ্য, যা এটিকে কেবল একটি জেলার সীমানা ছাড়িয়ে দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতের পবিত্র তীর্থে রূপান্তরিত করেছে। এই পুণ্যভূমিতে জন্মেছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ—এক মহান সংগীত সাধক, যাঁর সরোদের সুর আর অতুলনীয় দর্শন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতকে বিশ্বমঞ্চে অমর করে রেখেছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাইহার ঘরানা পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলী আকবর খাঁ, আমজাদ আলী খানের মতো কিংবদন্তিদের হাত ধরে বিশ্বের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। 


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি পথঘাট, গাছের ছায়া, আর মাটির গন্ধ যেন সেই সুরের সাক্ষর বহন করে। এই প্রতিবেদনে আমরা খুঁজে ফিরব সেই অমর সুরের উৎস, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে দক্ষিণ এশিয়ার সংগীতের মহাকাব্যে পরিণত করেছে।


উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ: সুরের মহর্ষি
১৮৬২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন সংগীতের এক জীবন্ত মহাকাব্য। তাঁর জীবন ছিল সুরের প্রতি অপরিমেয় ভালোবাসা আর অক্লান্ত সাধনার এক অলৌকিক যাত্রা। শৈশব থেকেই সংগীতের প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল এমন এক ঐশ্বরিক টান, যা তাঁকে পরিবার ত্যাগ করে সুরের সন্ধানে পথে নামিয়েছিল। কোলকাতার সংগীতময় গলি থেকে মধ্যপ্রদেশের মাইহার রাজদরবার—তাঁর যাত্রা ছিল এক সংগীত তীর্থযাত্রা। মাইহারে তিনি গড়ে তোলেন তাঁর স্বপ্নের ঘরানা—মাইহার ঘরানা, যা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের এক অমর অধ্যায়।



তিনি ছিলেন এক বহুমুখী স্রষ্টা। সরোদ, সেতার, বাঁশি, তবলা—একাধিক যন্ত্রে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তিনি শুধু বাজাতেন না, নতুন যন্ত্র তৈরি ও পরিমার্জন করে সংগীতের সীমানা প্রসারিত করেছেন। তাঁর হাতে রাগের বিন্যাসে এসেছে নতুন প্রাণ, যন্ত্রসংগীত পেয়েছে অভিনব গভীরতা। তাঁর শিষ্যরা—পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ আলী আকবর খাঁ, আমজাদ আলী খান—তাঁর দর্শনকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন সংগীতের এক মহর্ষি, যাঁর সুরে মিশে ছিল আধ্যাত্মিকতা, আর যাঁর সাধনা ছিল বিশ্বসংগীতের এক অমর আলো। তাঁর জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাই শুধু একটি শহর নয়, সুরের এক পবিত্র তীর্থ।



সঙ্গীতাঙ্গন: সুরের ঐশ্বরিক মন্দির
শিবপুরে উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পৈতৃক ভিটায় অবস্থিত ‘উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন’ কেবল একটি সংগ্রহশালা নয়, এটি সুরের এক ঐশ্বরিক মন্দির। এখানে সযত্নে সংরক্ষিত রয়েছে তাঁর ব্যবহৃত সরোদ, সেতার, তানপুরা, হারমোনিয়াম—যেগুলো যেন এখনও তাঁর স্পর্শের উষ্ণতা ধরে রেখেছে। এই সঙ্গীতাঙ্গন বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের কাছে এক পুণ্যতীর্থ, যেখানে তারা এসে অনুভব করে সেই সুরের মায়া, যা উস্তাদের হাতে জন্ম নিয়েছিল।


এখানে নিয়মিত আয়োজিত হয় বিশ্বমানের সংগীত উৎসব, কর্মশালা, সেমিনার, যেখানে দেশ-বিদেশের শিল্পীরা মিলিত হন। এটি কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বরং একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন, যা উস্তাদের দর্শনকে বাঁচিয়ে রাখে। এই সঙ্গীতাঙ্গন বাংলাদেশের সংগীতচর্চার এক প্রাণকেন্দ্র, যেখানে প্রতিটি নোট, প্রতিটি ধ্বনি যেন উস্তাদের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহন করে। এটি এক জীবন্ত তীর্থ, যেখানে সুরের ঈশ্বর এখনও বিরাজ করেন।


ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুর: এক অমর ঐতিহ্য
ব্রাহ্মণবাড়িয়া যেন সংগীতের এক জিনগত উত্তরাধিকার। এই শহরের মাটিতে শুধু উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ নন, জন্ম নিয়েছেন তাঁর ভাই উস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ছেলে উস্তাদ আলী আকবর খাঁ, ভাইপো উস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, নাতি উস্তাদ খুরশীদ খান—প্রত্যেকেই সংগীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। এই শহরের পরিবেশ, সংস্কৃতি, পরিবারগুলো যেন সুরের একেকটি কারখানা, যেখানে প্রতিটি শ্বাসে মিশে আছে রাগের আলাপ, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে বাজে তালের ছন্দ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাই কেবল একটি শহর নয়, এটি সংগীতের এক প্রাণকেন্দ্র, যেখান থেকে উৎসারিত হয়েছে বিশ্বজয়ী সুরের ধারা। এই শহর যেন এক সুরের জেনেটিক ল্যাবরেটরি, যেখানে প্রতিটি কণা সুরে বাঁধা।



বিশ্বমঞ্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধ্বনি
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ও তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুর পৌঁছে গেছে বিশ্বের প্রতিটি কোণে। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার, আলী আকবর খাঁ’র সরোদ, আমজাদ আলী খানের সুর বিশ্বের সংগীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করেছে। টোকিওর কনসার্ট হল থেকে লন্ডনের রয়্যাল অ্যালবার্ট হল, নিউ ইয়র্কের কার্নেগি হল—এই শহরের সুর বিশ্বের মঞ্চে প্রতিধ্বনিত। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবন নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, তাঁর সুর নিয়ে তৈরি হচ্ছে সিনেমা, ডকুমেন্টারি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাই কেবল একটি নাম নয়, এটি সংগীতের এক সার্বজনীন ভাষা, যার প্রতিটি নোটে মিশে আছে সাধনা, আধ্যাত্মিকতা ও স্বপ্ন।


ভবিষ্যতের দিগন্ত ও আমাদের দায়িত্ব
উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি ও উত্তরাধিকার আজ অবহেলার ছায়ায় ম্লান হতে বসেছে। এখনই সময় এই মহান সাধকের অবদানকে পুনরুজ্জীবিত করার। আমাদের দায়িত্ব হলো এই ঐতিহ্যকে বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো হলো: -

১. উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ আন্তর্জাতিক সংগীত বিশ্ববিদ্যালয়: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি বিশ্বমানের সংগীত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, যেখানে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে বিশ্বমঞ্চের সংগীতজ্ঞ হিসেবে।
২. বিশ্ব সংগীত মহোৎসব: প্রতি বছর একটি আন্তর্জাতিক সংগীত মহোৎসব, যেখানে ভারত, পাকিস্তান, ইউরোপ, আমেরিকার শিল্পীরা মিলিত হবেন, আর ব্রাহ্মণবাড়িয়া হবে বিশ্বসংগীতের মিলনকেন্দ্র।
৩. সঙ্গীত নগরী ও ডিজিটাল আর্কাইভ: ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘সঙ্গীত নগরী’ ঘোষণা করে একটি অত্যাধুনিক ডিজিটাল আর্কাইভ ও গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখানে সংরক্ষিত থাকবে উস্তাদের জীবন, সৃষ্টি ও দর্শন।
৪. তরুণ প্রজন্মের সংযোগ: স্কুল-কলেজে সংগীত শিক্ষা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে কর্মশালা, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তরুণদের সুরের পথে আনা।
এই পদক্ষেপগুলো না নিলে আমরা কেবল এক কিংবদন্তিকে হারাব না, হারাব আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, গর্ব ও ঐতিহ্য।


সুরের অমর তীর্থ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া কেবল একটি শহর নয়, এটি সুরের এক অমর তীর্থ, যেখানে প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি বাতাস, প্রতিটি হৃদস্পন্দন সুরে বাঁধা। উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ছিলেন সেই মহান স্রষ্টা, যাঁর সুরে জেগে উঠেছিল উপমহাদেশের সংগীত। তাঁর শিষ্যদের মাধ্যমে সেই সুর আজও বিশ্বে বাজছে, এক অমর ধ্বনির মতো। আমাদের দায়িত্ব এই ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, নতুন প্রজন্মের হাতে তুলে দেওয়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ‘বিশ্ব সঙ্গীতনগরী’ হিসেবে গড়ে তুলে আমরা যদি নতুন উস্তাদদের জন্ম দিতে পারি, তবেই উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা পূর্ণ হবে। এই শহরের প্রতিটি কণা, প্রতিটি শ্বাস যেন গাইছে একটি গান—ব্রাহ্মণবাড়িয়া সুরের পবিত্র তীর্থ, আমাদের চিরন্তন গর্ব।