দুরন্ত ডেস্ক :
শেখ মুজিবুর রহমানের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনাসদস্য ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোড়ের বাড়িতে তাকে সপরিবারে হত্যা করে। তবে তার দল আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নেই কোনো কর্মসূচি।
গত বছর ছাত্র–জনতার অবিস্মরণীয় অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতন হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে এখন আর সরকারি ছুটি নেই। গত বছর এই ছুটি বাতিল করা হয়। গত বছরের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের দিন ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুরের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর করা হয়। এর ছয় মাস পর দ্বিতীয়বার হামলা চালিয়ে বাড়িটি ভেঙে ফেলা হয়।
গত শতকের ষাটের দশকের শেষ দিকে দেশে সুপরিচিত অনেক রাজনীতিবিদ থাকলেও শেখ মুজিবুর রহমান তার নেতৃত্বগুণে অন্যদের ছাপিয়ে চলে আসেন সামনের কাতারে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে আদর্শিক ভিত্তি করে দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা।
১৯২০ সালে গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন শেখ মুজিবুর রহমান। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান, মা সায়েরা খাতুন। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে অধ্যয়নকালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতো রাজনৈতিক নেতাদের সান্নিধ্যে আসেন। এসব নেতার সাহচর্যে তিনি নিজেকে ছাত্র-যুবনেতা হিসেবে রাজনীতির অঙ্গনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ-পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির প্রাথমিক পর্যায়ে শেখ মুজিব ছিলেন তরুণ ছাত্রনেতা। পরে তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি হন। সমাজতন্ত্রের পক্ষসমর্থনকারী একজন অধিবক্তা হিসেবে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক জীবনে প্রায় ১৩ বছর কারাভোগ করেন। জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা স্বায়ত্তশাসন পরিকল্পনা প্রস্তাব করেন, যাকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী পরিকল্পনা হিসেবে ঘোষণা করেছিল। ছয় দফা দাবির মধ্যে প্রধান দাবি ছিল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন, যার কারণে তিনি আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের অন্যতম বিরোধী পক্ষে পরিণত হন। ১৯৬৮ সালে ভারত সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তাকে প্রধান আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়; তবে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের কারণে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করা সত্ত্বেও তাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের দিনগুলোতে মুক্তিসেনাদের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। সেদিন সমবেত লাখো মানুষের সামনে জাতীয় আকাঙক্ষা প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পর মুজিব ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন এবং পরবর্তী তিন বছর উক্ত পদে আসীন থাকেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে তিনি রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হন। তার শাসনামলে ব্যাপক নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয় বাকশাল গঠন, একদলীয় শাসনব্যবস্থা, রক্ষীবাহিনী দিয়ে বিরুদ্ধ মত দমন, ভারতের প্রতি নতজানু নীতি এবং বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বেচ্ছাচারিতার ফলস্বরূপ। শাসনব্যবস্থার প্রতি চরম অসন্তোষের পাশাপাশি ১৯৭৪ সালে দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ। ফার ইস্টার্ন ইকনোমিক রিভিউ পত্রিকায়, ১৯৭৪ সালে লরেন্স লিফশুলতজ লেখেন যে, সে সময় বাংলাদেশে ‘দুর্নীতি ও অনাচার এবং জাতীয় সম্পদের লুণ্ঠন’ বিগত সময়ের সকল দুর্নীতির ‘সীমা অতিক্রম করেছিল’।
শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে তার সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, শেখ মুজিবুর রহমানের একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর ফোন পেয়ে তার জীবন বাঁচাতে ছুটে আসা কর্নেল জামিল, এসবির কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান ও সেনাসদস্য সৈয়দ মাহবুবুল হককে হত্যা করা হয়।
১৫ আগস্টের সেই রাতে সেনাসদস্যদের আরেকটি দল শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগনে যুবলীগের নেতা শেখ ফজলুল হক মনির বাসায় হামলা চালিয়ে তাকে, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় হামলা করে তাকে ও তার কন্যা বেবি, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত বাবু, সেরনিয়াবাতের বড় ভাইয়ের ছেলে সজীব সেরনিয়াবাত এবং এক আত্মীয় আবদুল নঈম খানকে হত্যা করা হয়।
ওই সময় শেখ মুজিবুর রহমানের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে অবস্থান করায় বেঁচে যান।
১৫ আগস্টের সেই হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এরপর হত্যাকারীদের বিচার শুরু হয়। একইসঙ্গে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস এবং এই দিনে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়।
১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। পরে উচ্চ আদালত ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এখন পর্যন্ত ছয় আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। একজন বিদেশে মারা গেছেন। পাঁচজন এখনও পলাতক।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। এ দফায় টানা প্রায় সাড়ে ১৫ বছরের শাসনকালে আওয়ামী লীগ ১৫ আগস্ট এবং ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলাকে ঘিরে মাসব্যাপী কর্মসূচি পালন করত। ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে এবং গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার কবরে শ্রদ্ধা জানানোসহ নানা আয়োজন করা হতো।
ধানমন্ডিতে ১৫ আগস্ট ঘিরে কড়া নিরাপত্তা
রাজধানীর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় ১৫ আগস্ট কেন্দ্র করে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে পুলিশ। একইসঙ্গে এই এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নাশকতা ঠেকাতে এই বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই ৩২ নম্বর এলাকার প্রবেশপথগুলোতে ব্যারিকেড বসিয়ে যানবাহন ও পথচারীর চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
এ বিষয়ে রমনা বিভাগের ধানমন্ডি জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) জিসানুল হক বলেন, ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে ৩২ নম্বর এলাকায় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার যেন অবনতি না হয়, সে বিষয়ে পুলিশ তৎপর রয়েছে। আমাদের কাজ হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। আইনশৃঙ্খলার অবনতি হতে পারে বিষয়টি মাথায় রেখে পুলিশ সব সময় তৎপর রয়েছে।
কোনো হুমকি আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো সেরকম কোনো আশঙ্কা দেখি না। আমাদের পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন আছে।