দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। আখাউড়ার ইমিগ্রেশনে দুর্নীতির পর্দা ফাঁসে - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Wednesday, 20 August 2025

আখাউড়ার ইমিগ্রেশনে দুর্নীতির পর্দা ফাঁসে


জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি

সাংবাদিকদের উপর মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে উপদেষ্টার নিকট স্মারকলিপি

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার 

আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট, যেখানে প্রতিদিন শত শত মানুষ স্বপ্ন নিয়ে সীমান্ত পারাপার করে, সেই প্রতিষ্ঠানটি এখন দুর্নীতির কালো থাবায় জর্জরিত। এই দুর্নীতির কালিমা উন্মোচন করতে গিয়ে দুই সাহসী সাংবাদিক—দৈনিক যুগান্তরের জেলা স্টাফ রিপোর্টার ও আখাউড়া প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. ফজলে রাব্বি এবং আরটিভির আখাউড়া প্রতিনিধি ও আখাউড়া রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক মো. সাদ্দাম হোসেন—এখন হয়রানির শিকার। তাদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছেন ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার। এই মামলা কেবল দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে নয়, এটি সাংবাদিকতার স্বাধীনতার উপর সরাসরি আঘাত, জনগণের জানার অধিকারের উপর চপেটাঘাত। এই অবিচারের প্রতিবাদে আখাউড়ার সাংবাদিক সমাজ মঙ্গলবার (১৯ আগস্ট) বিকেল ৪টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) অতীশ দর্শী চাকমার মাধ্যমে স্বরাষ্ট্র ও তথ্য উপদেষ্টার কাছে একটি স্মারকলিপি প্রেরণ করেছে, যাতে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, দায়ী কর্মকর্তাদের অপসারণ এবং ইমিগ্রেশনের দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে। এই স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন আখাউড়া প্রেসক্লাবের সভাপতি শাহাদাত হোসেন লিটন, টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সাইফুল ইসলাম এবং রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি রুবেল আহমেদ। এই ঘটনা শুধু আখাউড়ার নয়, গোটা দেশের সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন—সত্য প্রকাশের অপরাধে কি সাংবাদিকদের এভাবেই নিগৃহীত হতে হবে?


ঘটনার শুরু গত ৪ আগস্ট আরটিভি অনলাইন এবং ৭ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত দুটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে। এই প্রতিবেদনগুলো আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টে চলমান দুর্নীতির এক চাঞ্চল্যকর চিত্র তুলে ধরে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বে উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুর রহিম এবং কনস্টেবল দেলোয়ার হোসেনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা মেডিকেল ভিসায় ভারতে যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কে ঘুষ আদায় করছেন। টাকা না দিলে যাত্রীদের নানা অজুহাতে হয়রানি করা হচ্ছে, এমনকি সীমান্ত পারাপার বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। অবৈধ পারাপারের মতো গুরুতর অভিযোগও উঠে এসেছে। এই প্রতিবেদনগুলো তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তৈরি, যা সাংবাদিক ফজলে রাব্বি এবং সাদ্দাম হোসেন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে প্রকাশ করেছেন। কিন্তু সত্য উন্মোচনের এই সাহসী পদক্ষেপের জবাবে তারা পেয়েছেন মিথ্যা মামলার জাল। গত ১২ আগস্ট ওসি আব্দুস সাত্তার আখাউড়া থানায় চাঁদাবাজি ও মানহানির অভিযোগে এই মামলা দায়ের করেন, যা স্থানীয় সাংবাদিক সমাজ ‘হয়রানিমূলক’ এবং ‘সাংবাদিকতার কণ্ঠরোধের চেষ্টা’ হিসেবে অভিহিত করেছে।


এই মামলার প্রতিবাদে গত ১৫ আগস্ট আখাউড়ার পৌর মুক্তমঞ্চের সামনে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। স্থানীয় সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের আয়োজনে এই কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ, ঐক্যবদ্ধ আখাউড়া, ইনসানিয়াত বিপ্লবসহ বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন সংহতি প্রকাশ করে। মানববন্ধনে তিন দফা দাবি উত্থাপিত হয়: ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার, ইমিগ্রেশন ওসি মোহাম্মদ আব্দুস সাত্তার এবং আখাউড়া থানার ওসি মো. ছমিউদ্দিনের অপসারণ, এবং প্রকাশিত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে দুর্নীতির সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা। বক্তারা বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পণ। তারা অন্যায়-অনিয়ম, দুর্নীতি, জনদুর্ভোগের সংবাদ প্রকাশ করে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে। কিন্তু আখাউড়ার ঘটনা প্রমাণ করে, সত্য প্রকাশের পথে বাধা সৃষ্টি করতে কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তি কতটা নির্মম হতে পারে।


ফজলে রাব্বি বলেন, “আমরা পেশাগত দায়িত্ব থেকে তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশ করেছি। এই মামলা হয়রানিমূলক এবং সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা।” সাদ্দাম হোসেনের কথায় আরও তীব্রতা: “সাংবাদিকের কাজ সত্য প্রকাশ করা, ভয় বা চাপের কাছে নতি স্বীকার করা নয়। ইমিগ্রেশন ওসির বিরুদ্ধে সঠিক তদন্ত হলে দুর্নীতির চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠবে।” তিনি অভিযোগ করেন, আখাউড়া থানার ওসি ছমিউদ্দিন তদন্ত ছাড়াই মামলাটি নথিভুক্ত করে নিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলেছেন। আখাউড়া সাংবাদিক কল্যাণ সোসাইটির সভাপতি নাসির উদ্দিন বলেন, “অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ করলেই যদি মামলা হয়, তাহলে সত্য প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবে। আমরা সাংবাদিকদের পাশে আছি এবং এই মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।”


এই ঘটনা কেবল আখাউড়ার নয়, গোটা বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জন্য একটি বিপদসংকেত। সাংবাদিকরা যখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কলম ধরেন, তখন তাদের উপর মামলার মতো হীন কৌশল প্রয়োগ কি দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে না? আখাউড়া ইমিগ্রেশন একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান, যেখানে দুর্নীতি শুধু স্থানীয় নয়, আন্তর্জাতিক মর্যাদার উপরও কালো ছায়া ফেলে। স্মারকলিপি প্রদানের সময় উপস্থিত ছিলেন আখাউড়া প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি কাজী হান্নান খাদেম, সাংবাদিক কল্যাণ সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক তাজবীর আহমেদ, টেলিভিশন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জালাল উদ্দিন মামুন, রিপোর্টার্স ইউনিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল আহমেদ রনি, সাংবাদিক কল্যাণ সোসাইটির অর্থ সম্পাদক মোহাম্মদ আবির, আখাউড়া উপজেলা প্রেসক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান মাহমুদ পারভেজ এবং আখাউড়া প্রেসক্লাবের সদস্য অমিত হাসান অপু। তাদের সবার কণ্ঠে একটাই দাবি—সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে হবে।


ইউএনও অতীশ দর্শী চাকমা বলেন, “সাংবাদিকরা স্বরাষ্ট্র ও তথ্য উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন। আমি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উপরে পৌঁছে দেব।” এই প্রতিশ্রুতি সাংবাদিক সমাজের জন্য একটি আশার আলো। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়—এই মামলা কি শুধুই দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে, নাকি এটি গোটা সাংবাদিকতার স্বাধীনতার উপর আঘাত? দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের জন্য সাংবাদিকদের এভাবে হয়রানি কি একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক সমাজের চিত্র? এই ঘটনা আমাদের সবাইকে ভাবতে বাধ্য করে—সত্যের পথে কত বাধা আসবে, আর কত সাহসী কলম ভাঙার চেষ্টা চলবে? আখাউড়ার এই ঘটনা শুধু একটি সংবাদ নয়, এটি একটি জীবন্ত আন্দোলন, যা প্রতিটি নাগরিকের বিবেককে নাড়া দেবে।