রাজনীতি প্রতিবেদক :
জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় মতামত দিয়েছে ৫টি দল
জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫-এর সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়ায় মতামত দেওয়ার জন্য আরও দুদিন সময় বাড়িয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। আগামীকাল শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত মতামত দিতে পারবে রাজনৈতিক দলগুলো। গতকাল বুধবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জনসংযোগ দপ্তর থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
এদিকে গতকাল পর্যন্ত পাঁচটি রাজনৈতিক দল মতামত জমা দিয়েছে বলে জানা গেছে। সনদের সমন্বিত চূড়ান্ত খসড়া গত শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। গতকালের মধ্যে দলগুলোকে পর্যালোচনা করে মতামত দেওয়ার সময় দেওয়া হয়েছিল। তবে কয়েকটি দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে দুদিন সময় বাড়িয়েছে কমিশন। গতকাল যেসব দল মতামত দিয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে বিএনপি, আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট ও আমজনতা পার্টি। বাসদ, সিপিবি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জাসদসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল সময় বৃদ্ধির আবেদন করেছে।
এরই মধ্যে সনদের খসড়া নিয়ে দলগুলো নিজেরা একাধিক সভা করেছে। খসড়া পর্যালোচনা করে বিভিন্ন বিষয়ে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি চিহ্নিত করেছে তারা। জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের গতকাল কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা কমিশনে এখনো মতামত জমা দিইনি। কিছু বিষয়ে অসংগতি মনে হয়েছে। সেগুলো পর্যালোচনা করছি। চূড়ান্ত মতামত দেওয়ার আগে আমরা ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে কথা বলে কিছু বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইব। তারপর মতামত জমা দেব।’
মিত্রদের ‘কাছাকাছি মতামত’ দেওয়ার পরামর্শ বিএনপির: জুলাই সনদের যে পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল, যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের সঙ্গে আলোচনা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের পর তার ওপর লিখিত মতামত দিয়েছে বিএনপি। গতকাল সন্ধ্যায় ঐকমত্য কমিশনে তা জমা দিয়েছে দলটি। জানা গেছে, নির্বাচনের স্বার্থে যতটা ছাড় দেওয়া দরকার, মতামতে ততটা ছাড় দিয়েছে বিএনপি। দলটির এখন প্রত্যাশা, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই সনদ প্রণীত ও বাস্তবায়িত হবে। তবে অঙ্গীকারনামায় থাকা কয়েকটি প্রস্তাবে দলীয় ভিন্নমত থাকলেও আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে এর আইনি বৈধতা এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়া খুঁজে বের করা যাবে বলে বিশ্বাস বিএনপির। জুলাই সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য কমিশন আগামীতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যে বৈঠকের পরিকল্পনা করছে, সেখানে এ ব্যাপারে তাদের মতামত তুলে ধরবে দলটি।
এদিকে জুলাই সনদ নিয়ে মিত্রদের অভিন্ন বা কাছাকাছি মতামত দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি। একই সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এর আগে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেওয়া বিষয়গুলো সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়ায় না এলে সেটা উল্লেখপূর্বক নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মতামত জমা দেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে। জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে গত দুদিনে মিত্রদের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের এমন পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে যে আট দফা অঙ্গীকারনামার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করছে বিএনপি। দল ও মিত্রদের অভিমত, রাজনৈতিক দলগুলো যখন এই সনদে স্বাক্ষর করবে, সেটিই মূলত অঙ্গীকার। এর বাইরে আলাদা করে আর অঙ্গীকারের প্রয়োজন নেই। তারপরও পৃথকভাবে অঙ্গীকারনামা রাখতে হলে সেটি যৌক্তিক পর্যায়ে থাকতে হবে।
খসড়ায় অঙ্গীকারনামার দ্বিতীয় দফায় বলা হয়েছে, ‘জনগণের সর্বোচ্চ অভিব্যক্তি হিসেবে জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫ প্রণয়ন করা হয়েছে বিধায় এই সনদের সব বিধান, নীতি ও সিদ্ধান্ত সংবিধানে অন্তর্ভুক্তকরণ নিশ্চিত করা হবে এবং বিদ্যমান সংবিধান বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর কিছু থাকলে সে ক্ষেত্রে এই সনদের বিধান/প্রস্তাব/সুপারিশ প্রাধান্য পাবে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিএনপির পক্ষে স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু এবং গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষে সমন্বয়ক ও ভাসানী জনশক্তি পার্টির শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের হাসনাত কাইয়ূম, জেএসডির সিরাজ মিয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। বিএনপি ও জোটের নেতারা মনে করেন, জুলাই সনদকে সংবিধানের ওপরে স্থান দেওয়া সঠিক হবে না। কারণ, কোনো সমঝোতা দলিল, ডকুমেন্ট বা নথির অবস্থান সংবিধানের ওপরে হতে পারে না। এমনটা করা হলে ভবিষ্যতের জন্য খারাপ নজির হবে।
অঙ্গীকারনামার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, ‘জুলাই সনদের প্রতিটি বিধান, প্রস্তাব ও সুপারিশ সাংবিধানিক ও আইনগতভাবে বলবৎ হিসেবে গণ্য হবে বিধায় এর বৈধতা, প্রয়োজনীয়তা কিংবা জারির কর্তৃত্ব সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না।’ এ বিষয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের অভিমত হচ্ছে, কোনো নাগরিক যদি তার জীবন, সম্পদ বা অন্যান্য যে কোনো বিষয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বা প্রশ্ন উত্থাপিত হয়, তার আইনি আশ্রয় লাভের অধিকার আছে, প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে। এ দিক দিয়ে এটি (প্রশ্ন না তোলার বিধান) ঠিক হবে না।
জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে ঐকমত্য কমিশন এরই মধ্যে বিভিন্ন এক্সপার্টের সঙ্গে কথা বলেছে। জানা গেছে, গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে সনদের বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়েও আলোচনা হয়েছে। আলোচনার এক পর্যায়ে মঞ্চের নেতারা বলেন, জুলাই সনদের আইনি সুরক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও উচ্চ আদালতের রেফারেন্সের ভিত্তিতে শপথ নিয়েছে। জুলাই সনদের ক্ষেত্রেও সেটি অনুসরণ করা যেতে পারে। বিএনপির পক্ষ থেকে তখন জানানো হয়, আগামীতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে মঞ্চের পক্ষ থেকে এমন মতামত বা পরামর্শ দেওয়া হলে বিএনপি তাতে আপত্তি জানাবে না।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ কালবেলাকে বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আলোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণের পর জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ খসড়া নিয়ে জোটের মতামত চূড়ান্ত করা হয়েছে।’
খসড়ায় এবি পার্টির মতামতের বেশকিছু প্রতিফলন ঘটেছে: এবি পার্টি ঐকমত্য কমিশনে মতামত দিয়েছে। দলটির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবিত সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত খসড়ায় (সংশোধিত) আমাদের মতামতের বেশকিছু প্রতিফলন ঘটেছে। অর্থাৎ প্রারম্ভিক বক্তব্য এবং ১-৪ নম্বর অনুচ্ছেদে আমাদের মতামতগুলো অনেকাংশে প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে, উল্লিখিত ১-৪ নম্বর অনুচ্ছেদে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। অনুচ্ছেদ-৫ ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়গুলো—(ক) অনুচ্ছেদ ৫(১)-(২০) পর্যন্ত আমাদের কোনো আপত্তি নেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এবি পার্টি এক কক্ষবিশিষ্ট আইনসভার পক্ষে হলেও জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আমাদের অবস্থান পরিবর্তন করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভা ব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে একমত পোষণ করেছিলাম এ শর্তে যে, নিম্নকক্ষের নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষের ১০০ (একশ) জন সদস্য নির্বাচিত হবেন। যদি উচ্চকক্ষে এ পদ্ধতির প্রচলন না হয়, তাহলে বাংলাদেশের সংসদীয় নির্বাচনে (নিম্নকক্ষে) অধিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে প্রাথমিকভাবে ১০০টি আসনে পিআর চালুর প্রস্তাব করছি। এ পদ্ধতিতে জাতীয়ভাবে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বণ্টন করা যেতে পারে, যা একটি প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র গড়ে তোলার সূচনা তৈরি করবে বলে মনে করি।’
মঞ্জু বলেন, ‘(গ) অনুচ্ছেদ ২২-২৯ পর্যন্ত আমাদের আপত্তি নেই। (ঘ) অনুচ্ছেদ ৩০—প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: অনুচ্ছেদ ৩০(৩)-এর বিষয়ে আমরা আপত্তি জানিয়েছিলাম। আমরা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বলেছিলাম, এটি আইনের দর্শনের পরিপন্থি। কারণ, অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নির্দোষ বলে বিবেচনা করাই আইনসম্মত। এ বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করার কথা থাকলেও তা আর আলোচ্যসূচিতে আসেনি। সেজন্য অনুচ্ছেদ ৩০(৩)-এর বিষয়টি পুনর্বিবেচনার অনুরোধ রাখছি। (ঙ) অনুচ্ছেদ ৩১-৮৪ পর্যন্ত আমাদের আপত্তি নেই।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অঙ্গীকারনামার অনুচ্ছেদ-৮ এ উল্লিখিত প্রস্তাবের সঙ্গে আমরা দৃঢ়ভাবে একমত পোষণ করছি। তবে, আমরা মনে করি, যেসব প্রস্তাব/সুপারিশ অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য এবং যেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য নয়, তার একটি সুস্পষ্ট তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়োজন। অন্যথায়, এ বিষয়টি নিয়ে সন্দেহ, সংশয় ও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের তৃতীয় পর্বের বৈঠক অনতিবিলম্বে শুরু হওয়া প্রয়োজন। কারণ, আমরা দাবি করছি, আসন্ন ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন জুলাই সনদের ওপর ভিত্তি করে অনুষ্ঠিত হবে।’
জুলাই সনদে উল্লিখিত সংবিধান সংক্রান্ত সংস্কারের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নে গণভোটের আয়োজন করা যায় কি না, সে বিষয়ে সরকার বিদ্যমান সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০৬-এর অধিক্ষেত্র অনুযায়ী পরামর্শ চাইতে পারে বলে মনে করেন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু।