২০০২ সালে মার্কিন কংগ্রেসে দেয়া এক সাক্ষাতে তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু দাবি করেছিলেন, ইরাকে আগ্রাসন চালানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের জন্য অত্যাবশ্যক এবং এতে ইরাক ও অন্যান্য সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাতে গণবিধ্বংসী অস্ত্র যাওয়া ঠেকানো যাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, যুদ্ধটি খুব দ্রুত শেষ হবে এবং এটি কেবল ইরাক নয়, গোটা অঞ্চলজুড়ে, এমনকি ইরানেও পশ্চিমাপন্থী গণতন্ত্রের নতুন যুগ সূচনা করবে।
কিন্তু তার এই দু’টি দাবিই মিথ্যা ছিল।
২০০৩ সালের আগ্রাসনের আগেই অনেক বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা জানতেন, সাদ্দাম হোসেনের শাসনে ইরাকের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র নেই এবং তাদের আল-কায়েদার সঙ্গে কোনো সম্পর্কও নেই। যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই ধ্বংস, অস্থিরতা, নিরাপত্তাহীনতা, সীমাহীন দুর্ভোগ ও শাসনব্যবস্থার ধ্বংস ডেকে আনবে- এটাই স্বাভাবিক ছিল। ঠিক তাই-ই ঘটেছে। আজকের ইরাক একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্র- রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। এ মাসের শুরুতে যখন ইসরাইল এবং পরে যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালায়, অনেক বিশ্লেষক বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরাক যুদ্ধ থেকে কোনো শিক্ষা নেয়নি এবং এখন আবার সেই একই ভুল করছে। তবে এই বিশ্লেষণগুলো তখনই সঠিক হতো, যদি ২০০৩ সালের আগ্রাসনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সত্যিই গণবিধ্বংসী অস্ত্রের বিস্তার রোধ বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হতো। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য তা ছিল না।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের মূল লক্ষ্য ছিল এমন একটি ইরাক, যা ফিলিস্তিনে ইসরাইলের উপনিবেশবাদী প্রকল্পের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলবে না এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী এজেন্ট হিসেবে কাজ করবে। আজ ইরানের ক্ষেত্রেও তাদের লক্ষ্য একই। যেমন ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার দাবিগুলো ভুল প্রমাণিত হয়েছিল, তেমনি ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের দ্বারপ্রান্তে এমন দাবি করারও কোনো প্রমাণ নেই। বরং আমরা দেখছি একটি নজিরবিহীন পরিমাণে দ্বিমুখিতা ও মিথ্যাচার।
এই মুহূর্তে দুইটি পরমাণু শক্তিধর দেশ- একটি (যুক্তরাষ্ট্র) ইতিহাসে একমাত্র রাষ্ট্র যারা দু’বার পরমাণু বোমা ব্যবহার করেছে। আরেকটি (ইসরাইল) যারা পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি এবং আত্মঘাতী ধ্বংসাত্মক পরমাণু নীতিতে চলে- তারা ‘প্রতিরোধমূলক আঘাতের’ নামে একতরফাভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে থামাতে চায় না, বরং তারা চায় এমন একটি ইরান- যা আর আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে না। এজন্যই ‘শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তনের’ ডাক ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে দেয়া হয়েছে।
নেতানিয়াহু, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ, মার্কিন সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম ও টেড ক্রুজ- এদের সবাই ইরানি সরকারকে উৎখাত করার দাবি তুলেছেন। রোববার ট্রাম্পও সামাজিক মাধ্যমে তেমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখন বলা হচ্ছে, ইরানি জনগণ যেন ‘উঠে দাঁড়ায়’ এবং ‘স্বাধীনতার’ জন্য লড়াই করে।
কিন্তু ইরানে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রই কি আসল লক্ষ্য? না, কারণ একটি সত্যিকারের স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক ইরান কখনোই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের স্বার্থরক্ষা করবে না বা ইসরাইলের দখলদারি বর্বরতাকে মেনে নেবে না। তারা বরং চায়- ইরান ফিরে যাক সেই নিপীড়নমূলক, রাজতান্ত্রিক শাসনে- যেমনটা ছিল ১৯৭৯ সালের আগে পাহলভি শাসনে, বা এমন কোনো রাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসুক যারা তাদের নির্দেশে চলে। তা সম্ভব না হলে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল চায়- একটি দুর্বল, বিভক্ত, অস্থির, গৃহযুদ্ধকবলিত ইরান- যেমনটা এখন ইরাক। মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া এবং সন্ত্রাস ও নাশকতা দিয়ে অস্থিরতা ছড়ানো- এই নীতি দীর্ঘদিন ধরেই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মিলে চলে আসছে।
১৯৯৬ সালে ‘এ ক্লিন ব্রেক’ নামে একটি নীতিপত্র তৈরি করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী রিচার্ড পার্ল ও অন্য কিছু রক্ষণশীল তাত্ত্বিক। তাতে বলা হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও হামলার মাধ্যমে ইসরাইলের কৌশলগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এই নীতি নতুন কিছু ছিল না- এটা মূলত পুরোনো সাম্রাজ্যবাদী কৌশল: বিভাজন ও বিশৃঙ্খলার মাধ্যমে আধিপত্য কায়েম। কিন্তু এই কৌশল ঝুঁকিবিহীন নয়। যেমন ইরাকের শাসনব্যবস্থা ধ্বংস হওয়ায় সেখানে উগ্র গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল এবং ইরান আরও শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলে। তেমনি ইরান ধ্বংস হলেও অনুরূপ ফল হতে পারে। আন্তর্জাতিক পরিসরে, যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের এসব আগ্রাসন আরও দেশকে পরমাণু অস্ত্র অর্জনে উৎসাহিত করছে। কারণ এখন বিশ্ব দেখছে, যেসব রাষ্ট্রের পরমাণু অস্ত্র নেই, তাদের ওপর আগ্রাসন করা সহজ। ফলে এই যুদ্ধ বিশ্বের নিরাপত্তাকে কমাচ্ছে, বাড়াচ্ছে না।
ইসরাইলের জন্য বিস্তার ও অস্থিরতা কোনো সমস্যা নয়- যতক্ষণ না তা তাদের ফিলিস্তিন দখলদারি প্রকল্পকে সফল করে তোলে। তারা চায় পুরো অঞ্চল হাড়ভাঙা অবস্থায় নতজানু হয়ে থাকুক। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যখন এই অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়। ইরাক বা ইরানের অকার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থ, বিশেষ করে বৈশ্বিক জ্বালানিবাজারে নিয়ন্ত্রণ ও চীনের প্রভাব ঠেকানোর কৌশলকে ব্যাহত করে।
২০০৩ সালের ইরাক যুদ্ধের মতোই, এই যুদ্ধেরও মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে বিশ্বজুড়ে।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, ইরানবিরোধী আগ্রাসনের জবাবে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া ছিল অনেকটাই নীরব। কিছু ইউরোপীয় রাষ্ট্র পর্যন্ত এই আগ্রাসনে সমর্থন জানিয়েছে, যদিও এটি তাদের অর্থনীতির ওপরও বাজে প্রভাব ফেলতে পারে। যদি বিশ্ব সত্যিই নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ করতে চায়, তবে এই সাম্রাজ্যবাদী সহিংসতার প্রতি নীরব সমর্থন বন্ধ করতে হবে। এখন সময়- এই কঠিন সত্য স্বীকার করার যে, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র- এই দুই শক্তি প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলার প্রতীক। ইসরাইলের দখলদারি প্রকল্প একটি বৈধতা-বিহীন উচ্ছেদ, হত্যা ও নিধনের প্রকল্প।
মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা আনতে হলে, বিশ্বকে একদিকে ইসরাইলের দখলদারি প্রকল্প থামাতে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে একটি উপনিবেশ-উত্তর সমাধানে পৌঁছায়, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করতে হবে- তারা যেন তাদের লৌহকঠিন নিয়ন্ত্রণ থেকে মধ্যপ্রাচ্যকে মুক্ত করে দেয়। এটাই একমাত্র পথ-স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার।
(লেখক সামাজিক বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, মাউন্ট রয়্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা। অনলাইন আল জাজিরা থেকে তার লেখার অনুবাদ)