আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে একই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছিল জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দাবি আদায়ের পরপরই এই দুই দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে—এটা কি মতাদর্শগত বিরোধ, না কি রাজনৈতিক কৌশল?
ঘটনার সূত্রপাত— গত বৃহস্পতিবার। ওই রাতে এনসিপির নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বাসার সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু হয়। আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে এই কর্মসূচিতে একে একে ছাত্রশিবির, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলনসহ আরও কয়েকটি দল যোগ দেয়।
রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসমাগমও বাড়তে থাকে। শুক্রবার বিকেলে এই কর্মসূচি সরিয়ে নেওয়া হয় শাহবাগে। সেখানে দেখা যায়, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি বেশি।
শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচির সময় জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের নামে স্লোগান দেওয়া হয়। জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় বাধা দেওয়া হয়। এসব ঘটনা সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমালোচনা শুরু হয়।
এনসিপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘আমরা মধ্যপন্থার রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। কিন্তু অন্য সংগঠনের নেতিবাচক কাজের দায় এসে আমাদের ঘাড়ে পড়ে। এতে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। এই অবস্থায় দলের অনেক নেতা ও কর্মী এক ধরনের সংকটে পড়েন।’
এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘গণতন্ত্রে মতভেদ থাকবেই। কিন্তু তা যেন দেশের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর না হয়, তা নিশ্চিত করা রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের নামে তৈরি করা বয়ান থেকে মুক্তি। একই সঙ্গে চাই, জামায়াত ১৯৭১ সালের তাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করুক।’
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম দুটি ফেসবুক স্ট্যাটাস দেন। প্রথমটি পোস্ট করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুছে ফেললেও তার স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে।
স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ‘৭১-এর প্রশ্ন মীমাংসা করতেই হবে। যুদ্ধাপরাধের সহযোগীদের ক্ষমা চাইতে হবে। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে পাকিস্তানপন্থা বাদ দিতে হবে। পাকিস্তান এই দেশে গণহত্যা চালিয়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে সেই গণহত্যাকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।’
তিনি আরও লেখেন, ‘মুজিববাদী বামদেরও ক্ষমা নেই। এরা গুম-খুন, আর শাপলায় মোদিবিরোধী আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞের মাথা ছিল। এরা এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এদের পরাজয় হবেই।’
এই স্ট্যাটাস ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষোভে ফেটে পড়ে জামায়াত-শিবির। তাদের অনেক নেতাকর্মী ফেসবুকে মাহফুজ আলমকে নিয়ে পোস্ট দিতে থাকেন।
জামায়াত ও শিবিরের নেতারা প্রশ্ন তোলেন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে যৌথ আন্দোলনের সাফল্যের পরেই কেন এমন আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিলেন মাহফুজ?
শিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেন, ‘হাসনাত আবদুল্লাহ আন্দোলনে বড় ভূমিকা রেখেছেন। তার প্রশংসা হচ্ছে। সেখান থেকে নজর সরাতেই হয়তো মাহফুজ আলম এমন লিখেছেন। ইচ্ছাকৃতভাবে বিতর্ক তৈরি করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘জাতীয় সংগীতে বাধা দেওয়া বা বিতর্কিত কাজ যারা করেছে, তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত ছিল।’
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘একজন উপদেষ্টা কীভাবে একটি দলকে উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য করেন? তিনি শপথ নিয়েছেন নিরপেক্ষ থাকার। কিন্তু তা মানেননি। তিনি যদি রাজনীতি করতে চান, তাহলে পদ ছেড়ে করুক।’
পরে মাহফুজ আলম আরেকটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে আরও কড়া ভাষায় লিখেন, ‘আমাকে নিয়ে নোংরামি করতেসো, সমস্যা নাই। তোমরা যুদ্ধাপরাধের সহযোগী। এটা শেষ সতর্কতা। যারা চুপচাপ থেকে সুশীল ব্যানারে পাকিস্তানপন্থা চালিয়ে যাচ্ছো, তোমাদের রাজাকার পূর্বপুরুষদের চেয়েও বেশি ভুগতে হবে।’ এই স্ট্যাটাসও পরে মুছে ফেলেন তিনি। তবে স্ক্রিনশট ছড়িয়ে পড়ে।
জামায়াত ও শিবির এই ইস্যুতে একাধিক বৈঠক করেছে। কেউ কেউ মাহফুজের পদত্যাগের দাবি তুলেছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি।
ঘটনাটি নিয়ে, এনসিপির ভেতরেও অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। কারণ, জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির ঘনিষ্ঠতা নিয়ে আগেও আলোচনা হয়েছে। এখন এমন পোস্টে দলের ভাবমূর্তি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
সোমবার এনসিপির সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ ফেসবুকে লেখেন, ‘এমন বিভাজন কাউকে ভালো কিছু দেবে না। আপনারা নিজেরা নিজের ফাঁদে পড়ছেন।’
এনসিপির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিও দেওয়া হয়। সেখানে জামায়াতের নাম না বললেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানের জন্য সংশ্লিষ্টদের স্পষ্ট ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যারা ১৯৭১ সালে গণহত্যার বিরুদ্ধে ছিল না, তাদের উচিত নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করা। এতে জাতীয় ঐক্য ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সহযোগিতা হবে।’
এনসিপির একাধিক নেতা জানান, উপদেষ্টা পদে থাকলেও মাহফুজ আলমের দলের ওপর প্রভাব রয়েছে। তাই তার স্ট্যাটাসের পর এনসিপি থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিতে হয়েছে।
সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘আওয়ামী লীগের গণহত্যার বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম। সেই ঐক্য এখনো আছে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন মত থাকতেই পারে। সেটা যদি সুস্থভাবে হয়, তাহলে সেটা গণতন্ত্রেরই অংশ।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই দ্বন্দ্বের পেছনে রয়েছে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা, রাজনৈতিক অবস্থানের পার্থক্য এবং কৌশলগত হিসাব।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আন্দোলনের নেতৃত্ব কার হাতে, তা নিয়ে জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে রশিটানাটানি ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অবস্থানের পার্থক্য থেকেও এই সমস্যা তৈরি হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে এনসিপির দূরত্ব থাকায় জামায়াতের সঙ্গে কিছুটা সখ্যতা ছিল। এখন এই সখ্যতা থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে এনসিপি। সামনে জাতীয় নির্বাচন। তাই মুক্তিযুদ্ধ ও রাজাকার ইস্যুতে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করতে চাইছে তারা।’ সূত্র: বিবিসি