ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সাধারণ মানুষের জন্য *শান্তি যেন এখন সোনার হরিণ। তুচ্ছ ঘটনা, ব্যক্তিগত বিরোধ কিংবা সামান্য বাগ্বিতণ্ডাকে কেন্দ্র করে সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত সাড়ে তিন মাসে জেলাজুড়ে ছোটবড় **২৩৫টি সংঘর্ষের ঘটনা* ঘটেছে, যা স্থানীয় জনজীবনে চরম আতঙ্ক ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এসব সংঘর্ষে প্রাণহানিসহ *এক হাজারের বেশি মানুষ আহত* হয়েছেন।
সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদমাধ্যমে প্রায়ই "*তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দুই দল গ্রামবাসীর সংঘর্ষ" শিরোনামে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, কয়েক মাসের ব্যবধানে সংঘর্ষের মাত্রা বহু গুণ বেড়ে গেছে। এসব সংঘাতের মূলে রয়েছে **অবিশ্বাস্যরকমের ছোটখাটো কারণ* – কখনো গায়ে ধাক্কা দেওয়া, টিস্যু না পেয়ে ক্ষুব্ধ হওয়া, জমি থেকে শসা চুরি, হাঁসে ধান খাওয়া, এমনকি পূর্ববিরোধ বা গোষ্ঠীর আধিপত্য ধরে রাখার মতো বিষয়গুলোও প্রাণঘাতী সংঘর্ষের কারণ হচ্ছে। *টেঁটা-বল্লম হাতে নিয়ে গ্রামবাসীরা প্রায়শই একে অপরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে*, যার ফলে শুধু মৃত্যু নয়, অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছেন।
জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ থেকে ১৯ জুন পর্যন্ত এই ২৩৫টি সংঘর্ষের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে *সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলাতেই সংঘর্ষের সংখ্যা সর্বাধিক। এসব ঘটনা একদিকে যেমন সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাকে ব্যাহত করছে, অন্যদিকে পরিবারগুলোকে আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সংঘর্ষের পর থানা কিংবা আদালতে মামলা চালাতে গিয়ে ভুক্তভোগীরা গ্রামের সর্দার-মাতব্বর, থানা-পুলিশ ও আইনজীবীদের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এতে তাদের **সর্বস্বান্ত হওয়ার উপক্রম হচ্ছে*, তবুও গ্রামীণ জনপদের এই হিংসা-হানাহানি থামছে না।
দাঙ্গা-হাঙ্গামা বৃদ্ধির বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা দাবি করছেন, এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে এসব সংঘর্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আক্রান্ত হচ্ছেন। সংঘর্ষের পর পুলিশের করা মামলা, জামিন এবং প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে করা মামলার খরচ জোগাতে গিয়ে অনেকেই ব্যাপক আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। এতকিছুর পরও গ্রামে সংঘাতের আগুন জ্বলছেই।
সচেতন মহলের অভিযোগ, এই দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেড়ে যাওয়ার পেছনে *বৈদেশিক রেমিট্যান্সের অপব্যবহার, স্থানীয় সর্দার-মাতব্বরদের উসকানিমূলক ভূমিকা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা* বড় কারণ।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সংঘর্ষের প্রবণতা রোধে কেবল আইন প্রয়োগ যথেষ্ট নয়। এ বিষয়ে *সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি, গ্রাম ও মহল্লাভিত্তিক বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং তরুণদের নিয়ে গঠনমূলক কর্মকাণ্ডের আয়োজন জরুরি*। সরাইল সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার বলেন, গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব ও ঝগড়াবিবাদ রোধে ধৈর্য, সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতা বাড়াতে হবে। এভাবে সমাজে পরিবর্তন আনা সম্ভব। সরাইলের বাসিন্দা মুন্না নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নের ওপর জোর দিয়ে বলেন, চারিত্রিক ও নীতিগতভাবে সৎ হলে ঝগড়ার কোনো কারণ থাকে না। মশিউর রহমান নামে আরেক বাসিন্দা বলেন, আগে গ্রামের সর্দাররা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ঝগড়াঝাঁটি নিরসনের চেষ্টা করতেন, যা এখন আর দেখা যায় না।
এলাকার সচেতন মানুষ মনে করেন, দালাল-মাতব্বরদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ এবং দাঙ্গা-হাঙ্গামা রোধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে আরও কঠোর হতে হবে। অন্যথায় সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওবায়দুর রহমান সমাজের সবাইকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, পুলিশ এবং প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছেন এবং শিগগিরই এর একটি ইতিবাচক ফল আশা করছেন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এই পরিস্থিতি কেবল স্থানীয় সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিকভাবে সমাজের নৈতিক অবক্ষয় এবং আইনি প্রয়োগের সীমাবদ্ধতার এক করুণ চিত্র। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সরকার, প্রশাসন এবং সাধারণ মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টা এখন সময়ের দাবি। *এই সহিংসতা কি থামানো যাবে, নাকি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি রক্তে রঞ্জিত হতেই থাকবে, সেই প্রশ্ন এখন সকলের মনে।*