জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে
গ্রে-হাউন্ডের কান্না শুনতে পাচ্ছে কে? বিলুপ্তির মুখে দাঁড়িয়ে সরাইলের রক্তমাখা শিকারের ইতিহাস
একটা সময় ছিল, যখন সরাইলের প্রতিটি ভোর, প্রতিটি রাত, প্রতিটি উঠোনের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকত এক জাত শিকারের গন্ধ। বাতাসে ভেসে বেড়াত কুকুরের গর্জন, ঠিক যেন কোনো যুদ্ধবাজ যোদ্ধার ঘেউ-ঘেউ নয়, রীতিমতো এক জাতির আত্মপরিচয়ের চিৎকার। এই কুকুরের নাম—গ্রে-হাউন্ড। নাম শুনলেই যেন হাড়ে কাঁপন ধরে; শিয়াল, বনবিড়াল, বাঘদাস—সব এই কুকুরের শিকারে পরিণত হতো। সে কুকুর শুধু পাহারাদার ছিল না, সে ছিল সাহসের রূপকথা, শিকারের কবিতা, পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি। চোর-ডাকাতদের কাছে এই কুকুর মানে আতঙ্ক; আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে এই কুকুর মানে এক বিশ্বস্ত সহযোগী। এমনকি FBI-ও একে স্যালুট জানায়।
এই কুকুর দেখতে যেমন ব্যতিক্রম, গুণেও তেমনি অতুলনীয়—মুখে শেয়ালের ধূর্ততা, চোখে অপরাধীর নিশান, কান লম্বা, স্বভাব রাজকীয়। দুধ-ভাত, মাছ-মাংস খায়; অভিজাত খাবারে অভ্যস্ত, আর সাহসে অভ্যস্ত তার রক্ত। সরাইলবাসী বলে, এ কুকুর কোনো সাধারণ প্রাণী নয়—এ এক লিভিং লেজেন্ড।
এদের ঘিরে দুইটি মিথ গড়ে উঠেছে সরাইলে। এক দেওয়ান কলকাতা যাওয়ার পথে এক বাড়িতে দেখে ফেলেন এক অসাধারণ কুকুর। মালিক দিতে চায় না—শেষমেশ তিনি নিজের হাতি দিয়ে কুকুরটি কিনে নেন। কুকুরটি হয়ে ওঠে প্রজন্মের সম্পদ। অন্য গল্পটা আরও বুনো—জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া এক মাদী কুকুরকে এক বাঘের সঙ্গে মিলনে দেখা যায়, আর সেই সম্পর্কের ফলস্বরূপ নাকি জন্ম নেয় এই ‘বাঘের শিকারি, শিয়ালের ধূর্ত’ গ্রে-হাউন্ড!
যা-ই হোক, গল্প যেটাই হোক, সত্যটা স্পষ্ট—এই কুকুরের সাহস আর শিকারের ক্ষিপ্রতা কোনো গল্প নয়, একটা রক্তমাখা বাস্তবতা।
আজ, সেই কুকুর যেখানে একসময় পুরো উপজেলায় ছিল, এখন কেবল মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের উঠোনে টিকে আছে। যেন সময়ের এক করুণ প্রতিচ্ছবি—যেখানে অতীতের গৌরব আজ খাদ্যসংকটে ভুগে, রাষ্ট্রীয় উদাসীনতায় ঝিমিয়ে পড়ছে।
উপজেলার নোয়াগাঁও গ্রামের অজিত লাল দাস এই ঐতিহ্য রক্ষা করছেন নিজের জীবন দিয়ে। তাঁর ঘরে আজ ২০টি কুকুর—টাইগার, মধু, লালী, কালী—প্রতিটি কুকুরের পেছনে জড়িয়ে আছে ঘাম, চোখের পানি, স্বপ্ন আর অভাব। প্রতিদিন ২ লিটার দুধ শুধু ছোট বাচ্চাদের জন্য। উন্নত খাবার না দিলে বিক্রি করা যায় না। একটা বাচ্চা ২৫ হাজার, বড় কুকুর ৬৫ হাজার—দামে নয়, এই কুকুর বিক্রি হয় সাহসে।
চোর-ডাকাতের হুমকি, খাবারের দামের আগুন, সরকারের উদাসীনতা—সব মিলিয়ে আজ এই ইতিহাস মরে যাচ্ছে নিঃশব্দে।
সরাইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, "এই কুকুর সরাইলের ঐতিহ্যের প্রতীক। আমরা প্রজনন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করছি।"
কিন্তু প্রশ্ন হলো—আর কতদিন পরিকল্পনার কফিনে বন্দি থাকবে সরাইলের সাহস?
এই কুকুর শুধুমাত্র পোষা প্রাণী নয়—এটা এক জাতির আত্মপরিচয়, এ এক ইতিহাসের জীবন্ত ভাস্কর্য, এটা এক অস্তিত্বের আত্মরক্ষা যুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকা যোদ্ধা।
রাষ্ট্র যদি চায়, এখনই সময় তাকে বাঁচানোর। না হলে গ্রে-হাউন্ডের বিলুপ্তি হবে শুধুমাত্র একটা প্রজাতির মৃত্যুই নয়—এ হবে আমাদের বিবেকের পরাজয়, শিকড়চ্যুত ইতিহাসের আত্মহত্যা।
আর যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, "এটা তো একটা কুকুরের গল্প!"—তাকে বলো, "না, ভাই। এটা আমার দেশের এক টুকরো সাহসের গল্প। এইটা শুধু একটা প্রাণী নয়—এইটা আমাদের অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের টিকে থাকার এক ছায়াযুদ্ধ।"
জাগো সরাইল, জাগো বাংলাদেশ—বাঁচাও গ্রে-হাউন্ডকে, কারণ তাকে বাঁচানো মানে নিজের শেকড়কে বাঁচানো