আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি অথবা এপ্রিলে হতে পারে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি, বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রস্তুতি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার এ নির্দেশনা ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বিএনপি। ঠিক এসময়ে এসে জাতীয় পার্টিতে ভাঙনের সুর, বিভক্তি আর দ্বিধায় দলটির নেতাকর্মীরা।
জাতীয় নির্বাচন এলেই যেন তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় জাতীয় পার্টি। এবারও রেওয়াজ মেনে নির্বাচনীকে সামনে রেখে দলটিতে ভাঙনের সুর। সম্প্রতি পার্টির মহাসচিবসহ বিদ্রোহী তিনজন নেতাকে বহিষ্কার করেন দলটির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এরপর থেকে বাজছে ভাঙনের সুর। বিষয়টি নিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে কোণঠাসা জাতীয় পার্টি।
দলকে নিজেদের কব্জায় রাখার চেষ্টায় নেমেছেন জিএম কাদের ও কয়েকজন বিদ্রোহী নেতা। বিদ্রোহী নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, কো-চেয়ারম্যান এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবং মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু। দলের সব পদ-পদবি থেকে তাদের অব্যাহতি দিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে পার্টির মহাসচিব নিয়োগ দিয়েছেন জিএম কাদের। অন্তর্কোন্দল, সিনিয়র নেতাদের অব্যাহতি, ফের ভাঙনের সুরসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জাতীয় পার্টির অন্তত ডজনখানেক নেতাকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে জাগো নিউজ।
সিনিয়র নেতাদের অব্যাহতি বিষয়ে নতুন মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, পার্টির চেয়ারম্যান দলের যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন, সেই ক্ষমতা তাকে গঠনতন্ত্রে দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তিন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়ার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা সঠিক নয়। গঠনতন্ত্রের ৩০(১) ধারা মোতাবেক প্রেসিডিয়ামের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে দলের চেয়ারম্যান যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। সম্পূর্ণ গঠনতন্ত্র মোতাবেক করা হয়েছে। তবে, আগামী প্রেসিডিয়াম সভায় সবার সম্মতি থাকলে তাদের অব্যাহতির আদেশ তুলে নেওয়া হতে পারে।
দলের ভাঙন নিয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা বলছেন, তারা নতুন করে ভাঙন চান না। তবে, নেতাকর্মীদের পক্ষে টেনে পার্টি ফোরামে জিএম কাদেরকে কোণঠাসা করতে চাইছেন।
জাতীয় পার্টি ভাঙনের চেষ্টা চলছে জানিয়ে দলের দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলম বলেন, নির্বাচন এলেই দলে একটা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ভাঙনটা কারা করে? ওই কয়েকজনই (অব্যাহতিপ্রাপ্তরা) করে। ২০১৪ সালে চেয়ারম্যান ভোট প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন, তারা করেননি। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের ভোটও করেছে। বিভিন্ন চাপের কারণে জিএম কাদের ভোটটা করলো।
জিএম কাদেরের পক্ষ নিয়ে এ নেতা বলেন, তিনি (জিএম) তো অনেক করলেন। আর কত করা যায়! এবার ভোটে জাতীয় পার্টিকে নাও রাখা হতে পারে। এটা হতেই পারে। আমরাও মানসিকভাবে প্রস্তুত। অব্যাহতি পাওয়াদের উদ্দেশ্য হলো নির্বাচন যাওয়া।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের মাইনাস করা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। আমাদের দোসর বলা হচ্ছে। এটা তারা (অব্যাহতি পাওয়া) মেনে নিতে পারছেন না, এ জন্য ডিগবাজি দিয়েছেন। তারা বিএনপি বা সরকারের সঙ্গে থেকে ক্ষমতার বলয়ে থাকতে চাইছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিএম কাদেরপন্থি এক সিনিয়র নেতা বলেন, এটা সত্য জাতীয় পার্টির ইমেজ সংকটে আছে। আগামী নির্বাচনে না গেলে দলের আরও বড় ক্ষতি হবে। তবে নির্বাচন নিয়ে কৌশল ঠিক করার সময় আসেনি। নির্বাচনের দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। যারা অব্যাহতি পেয়েছেন তারা সুবিধাভোগী, সবসময়ই সুবিধাজনক স্থানে ছিলেন। এখনো সরকারের সঙ্গে থাকার জন্য জিএম কাদেরকে চাপ দিচ্ছেন।
এদিকে, রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাঁটার ইঙ্গিত দিয়েছেন। আগে অব্যাহতি পাওয়া বাবলাসহ একাধিক নেতা চুন্নুর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন বলে জানা গেছে।
গত ২৮ জুন দশম কাউন্সিলের ঘোষণা দিয়েছিলেন জিএম কাদের। এতে চেয়ারম্যান ও মহাসচিব হওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।
বিজ্ঞাপন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ হারানোর ভয়ে এ কাউন্সিল স্থগিত করেন জিএম কাদের। পাশাপাশি ‘দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের’ দায়ে অব্যাহতি দেওয়া হয় কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে। কাউন্সিলের বিষয়ে দলীয় বার্তায় বলা হয়, স্থান না পাওয়ায় স্থগিত করা হয়েছে।
জানা যায়, সিনিয়র নেতারা গঠনতন্ত্রের ২০ এর ১ (ক) ধারা বাতিলের প্রস্তাব দেন। এ ধারার ক্ষমতাবলে যে কাউকে বহিষ্কার করতে পারতেন তিনি। ২০২৪ সালের নির্বাচনের সময় থেকে এপর্যন্ত শতাধিক নেতাকর্মীকে বহিষ্কার করেছেন জিএম কাদের। যে তালিকায় রয়েছেন অনেক প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যও।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘ফ্যাসিস্টের দোসর’ বা ‘আওয়ামী লীগের সহযোগী’ তকমা থেকে জাতীয় পার্টিকে বের করে আনার জন্য কেন্দ্রীয় সম্মেলন আয়োজনে জোর দিচ্ছিলেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এবিএম রুহুল আমিন তালুকদাররা। কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে।
জানতে চাইলে দলটির বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খান দুরন্ত বিডিকে বলেন, প্রেসিডিয়াম সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকার নেতৃত্বে একাধিক নেতা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবেন। যারা জিএম কাদেরের সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে রয়েছেন।
এ নেতা বলেন, কেউ দল ভাঙতে চান না। দল ভাঙবে না। আমরা ঐক্য চাই। জিএম কাদেরের অনৈতিক দাবি ও গঠনতন্ত্রের ২০ এর ১ (ক) পরিবর্তন করতে হবে। রওশনপন্থিসহ সবাই আমাদের সঙ্গে আসছে। ঐক্যের সঙ্গে সবাই একমত।
জাপা চেয়ারম্যানের সমালোচনা করে এ নেতা বলেন, একনায়কতন্ত্র দলের জন্য ভালো না। আলোচনা করে দল চালাতে হয়। উনি (জিএম কাদের) এতদিন শেখ হাসিনার ফাঁসি পর্যন্ত দাবি করেছেন। এখন বলছেন, শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচন হবে না। এ কথাগুলো দলের ক্ষতি করছে। তার মন্তব্যের জেরে সারাদেশে নেতাকর্মীরা বিপদে পড়ছেন।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, কোনোভাবেই জাতীয় পার্টিকে ভাঙতে দেওয়া হবে না। এ পার্টি যেন মুসলিম লীগ, জাসদের মতো হয়ে না যায়। সেজন্য জাতীয় পার্টিকে বড় করার চেষ্টা করছি। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, জাতীয় পার্টি ভাঙবে না, আরও বৃহৎ হবে।
জিএম কাদেরের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমরা যখন দেখলাম পদ নিয়ে পার্টিতে বাণিজ্য হয়, তখন আমি বাণিজ্য বন্ধ করার জন্য চেয়ারম্যানকে বলেছি। কিন্তু তিনি বন্ধ করেননি। গণতন্ত্র অনুযায়ী পার্টি পরিচালনার জন্য ২০-১ (ক) ধারা বাতিল করতে বলেছি। তিনি তাও শোনেনি। জিএম কাদের কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলেন, কিন্তু তিনি স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করছেন। এরশাদ সাহেবও কোনো সিদ্ধান্ত আমাদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া নিতেন না। কিন্তু উনি নিজেকে খোদার চেয়ে শক্তিশালী মনে করেন।’
মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কাউন্সিল আহ্বান করার পর কাউকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুযোগ নেই। তাই তড়িঘড়ি করে আমাদের অব্যাহতি দেওয়ার নাটক করেছেন। তবে তিনি সফল হতে পারবেন না।
জাতীয় পার্টির সিনিয়র নেতা লিয়াকত হোসেন খোকা বলেন, আমি জিএম কাদেরকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দলকে ঐক্যবদ্ধ করবার জন্য। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। জি এম কাদেরের আশপাশে থাকা কিছু তথাকথিত নেতা একটা সিন্ডিকেট করে নিজের ব্যক্তি স্বার্থে দলকে ছোট করছেন।
১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির ভাঙনের ইতিহাস এটাই প্রথম নয়। এর আগে ছয়বার ভেঙেছে দলটি। সবশেষ ২০২৪ সালের ৯ মার্চ রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিশনে কাউন্সিল করে নতুন কমিটি ঘোষণা দেয় রওশন এরশাদপন্থিরা। এতে তিন বছরের জন্য এরশাদপত্নী বেগম রওশন এরশাদ চেয়ারম্যান ও কাজী মামুনুর রশীদ মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পান।