দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। পুলিশের উপর হামলা: কবে থামবে এই রক্তাক্ত অরাজকতা? - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Tuesday, 2 September 2025

পুলিশের উপর হামলা: কবে থামবে এই রক্তাক্ত অরাজকতা?


জহির শাহ, বিশেষ প্রতিবেদক,

বাংলাদেশের রক্তরাঙা রাজপথে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ বাহিনী প্রতিনিয়ত হামলার শিকার হচ্ছে, যেন তাদের উপর ইট-পাটকেল, ছুরি, এমনকি সংঘবদ্ধ আক্রমণ এখন নিত্যদিনের দৃশ্য! কিন্তু এই হিংসার শেষ কোথায়? গত এক বছরে ৬৯টি হামলায় পুলিশ সদস্যরা আহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২০২৪ সালের প্রথম পাঁচ মাসেই ৩৪ জন পুলিশ সদস্য হামলার শিকার, এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের মে পর্যন্ত ৪৪৪টি সহিংস ঘটনায় ১১১ জন নিহত এবং ৪,৮৯২ জন আহত হয়েছেন।



এই ভয়াবহ পরিসংখ্যান দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতির নীরব সাক্ষী। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর থেকে থানা-ফাঁড়িতে হামলা, আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা, পুলিশের উপর সরাসরি আক্রমণ—এসব যেন সমাজের ক্রমবর্ধমান অস্থিরতা আর আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার প্রতিচ্ছবি। উদাহরণস্বরূপ, ৩১ আগস্ট ২০২৫, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের খাদুরাইল গ্রামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্ত আসামি মিজানুর রহমানকে ধরতে গিয়ে বিজয়নগর থানার পুলিশের উপর আসামির লোকজন অতর্কিত হামলা চালায়; এসআই নাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে অভিযানে ৬ জন পুলিশ সদস্য আহত, এএসআই শেখ সাদী গুরুতর জখম, তবুও আসামি গ্রেপ্তার হয় [জনকণ্ঠ]। 



এর আগে, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, বিজয়নগরের হরষপুরে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে, একাধিক পুলিশ আহত [প্রথম আলো]। ১১ জুলাই ২০২৪, খুলনার মুজগুন্নি বাস্তুহারা এলাকায় শ্লীলতাহানি ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি পলাশকে ধরতে গিয়ে হালিমা রহমানের নেতৃত্বে দুর্বৃত্তরা পুলিশের উপর হামলা চালায়, আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে; ফলাফল—৯ জন পুলিশ আহত, ৪ জন হাসপাতালে ভর্তি, ১৬ জন গ্রেপ্তার [প্রথম আলো]। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে, ৯ জুন ২০২৪, আসামি ধরতে গিয়ে হামলায় কর্ণফুলী থানার ওসি জহির হোসেন ও আনোয়ারার ওসি আহত, এখনো চিকিৎসাধীন [নিউজবাংলা২৪]। ঢাকার মোহাম্মদপুরে, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, বিক্ষোভকারীদের হামলায় একাধিক পুলিশ আহত, মামলা দায়ের [কালবেলা]। খুলনার কয়রায়, ২২ অক্টোবর ২০২৪, অপহরণ মামলার আসামি ধরতে গিয়ে হামলায় ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ৫ সদস্য আহত, আসামি ছিনিয়ে নেওয়া হয় [সমকাল]। চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে, ৫ নভেম্বর ২০২৪, ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সংঘর্ষে যৌথবাহিনীর উপর হামলায় ১২ জন পুলিশ ও সেনা সদস্য আহত [চ্যানেল২৪]। ২২ নভেম্বর ২০২৪, চট্টগ্রামের আকবরশাহে বিস্ফোরক মামলার আসামি রায়হান উদ্দিন গ্রেপ্তারের সময় নগর ডিবি পুলিশের কনস্টেবল নাছির উদ্দিন আহত, চমেক হাসপাতালে ভর্তি; ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ৫০-৬০ জন অজ্ঞাত আসামি [দৈনিক আজাদী]। ঢাকার গুলিস্তানে, ২২ মার্চ ২০২৫, শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেনকে টিএন্ডটি অফিসের সামনে ছুরিকাঘাত, আহত [ঢাকাটাইমস২৪]। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়, ১৫ মে ২০২৫, আসামি ধরতে গিয়ে হামলায় দুই পুলিশ আহত, একজনের কবজি বিচ্ছিন্ন [ঢাকাটাইমস২৪]। ঢাকার জুরাইনে, মে ২০২৫, উল্টোপথে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য থামানোর সময় শত শত লোক পুলিশ বক্সে হামলা চালায়, তিন পুলিশ সদস্যকে মারধর, ট্রাফিক বক্স ভাঙচুর; ৪৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলা, ২৩ জন গ্রেপ্তার [ঢাকাটাইমস২৪]। মোহাম্মদপুরে, মে ২০২৫, মুসল্লিদের মধ্য থেকে কয়েকজন যুবক মোহাম্মদপুর থানার ওসি ও এএসআই-এর উপর হামলা চালায়, আহত [ঢাকাটাইমস২৪]। আশুলিয়ায়, ২৩ মার্চ ২০২৫, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের সময় বিক্ষুব্ধ দখলদাররা পুলিশের উপর ইট-পাটকেল নিক্ষেপ, পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর, একাধিক পুলিশ আহত [বাংলা ট্রিবিউন]। এই ঘটনাগুলো কেবল পরিসংখ্যান নয়, সমাজের গভীরে লুকানো অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, আইনের প্রতি অশ্রদ্ধার জ্বলন্ত প্রমাণ। পুলিশ সদস্যরা প্রতিদিন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু সমাজের একাংশ তাদের শত্রু হিসেবে দেখছে, যা আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থাকে দুর্বল করছে। এই হামলাগুলো শুধু পুলিশের উপর নয়, দেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার উপর আঘাত। ২০২৪ সালের আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ২৭টি থানা-ফাঁড়ি, পুলিশ সুপারের কার্যালয়, রেঞ্জ অফিসে হামলা ও ভাঙচুর, তিন শতাধিক পুলিশ আহত [প্রথম আলো, ৪ আগস্ট ২০২৪]। এই হিংসার পেছনে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বিভেদ, ধর্মীয় উসকানি, এমনকি সামাজিক মাধ্যমে উসকানিমূলক পোস্টের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ২০২১ সালে নীনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, “পুলিশের পূর্বাভাস থাকলেও তিন দিন ধরে হামলা চলল কীভাবে?” [প্রথম আলো, ৫ নভেম্বর ২০২১]। তিনি পুলিশের প্রস্তুতির ঘাটতি, সমন্বয়ের অভাব, এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চার অভাবকে দায়ী করেন। এই প্রশ্ন আজও প্রাসঙ্গিক—কেন পুলিশ বারবার হামলার শিকার? কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষার প্রধান শক্তি নিজেই নিরাপত্তাহীন? সমাজের এই অরাজকতার শিকড় কোথায়? রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষার অভাব, ধর্মীয় উসকানি—এসব কি একত্রে এক বিষাক্ত ককটেল তৈরি করছে? ২০২২-২০২৩ সালের সরকারবিরোধী বিক্ষোভে শত শত গ্রেপ্তার, একজন বিক্ষোভকারীর মৃত্যু [উইকিপিডিয়া, ২৭ ডিসেম্বর ২০২২], এবং এই অশান্তির মাঝে পুলিশ প্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন ২০২৩ সালে বলেছিলেন, “কেউ শান্তি-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে” [পুলিশ ওয়েবসাইট, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩]। কিন্তু বাস্তবে কী হচ্ছে? হামলাকারীদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে, কিছু গ্রেপ্তার হচ্ছে, কিন্তু হামলা থামছে না। পুলিশের প্রশিক্ষণ, জনবল, গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতি কি এর কারণ? নাকি সমাজের মানসিকতায় গভীর পরিবর্তন প্রয়োজন? পুলিশ বাহিনীকে আধুনিকায়ন, নিয়োগে স্বচ্ছতা, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে [পুলিশ ওয়েবসাইট, ১৪ জুন ২০২৪],



কিন্তু এই প্রচেষ্টাগুলো কি যথেষ্ট? পুলিশের উপর হামলা শুধু শারীরিক আঘাত নয়, এটি রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের উপর হামলা, সমাজের শান্তির উপর হামলা। পুলিশ সদস্যরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, তাদের পরিবার উৎকণ্ঠায়, কিন্তু সমাজের একাংশ নীরব দর্শক। এই হিংসার চক্র থামাতে হলে কঠোর আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, এবং রাজনৈতিক সমঝোতা জরুরি। পুলিশের মনোবল রক্ষা করতে, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, এবং হামলাকারীদের কঠোর শাস্তি দিতে না পারলে আইনের শাসন কেবল কাগজের বুলি হয়ে থাকবে। প্রশ্ন উঠছে—আমরা কি এই অরাজকতাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেব? নাকি একসঙ্গে দাঁড়িয়ে এই হিংসার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলব? এই রক্তাক্ত পথ থেকে শান্তির পথে ফেরার দায়িত্ব কেবল পুলিশের নয়, আমাদের সবার। এই খবর শুধু তথ্য নয়, একটি জাগরণের ডাক—আমরা কি শুনব, নাকি নীরব থাকব?