দূরন্ত বিডি ডটকম -----------স্বাগতম ২০২৫------------মানবতার কথা বলে ---------- durontobd.com--------ফ্যাসিবাদ মুক্ত বাংলাদেশ চাই, “জুলাই” মনে রেখে ভোটের নিশ্চয়তা চাই, অর্থনৈতিক মুক্তি চাই। বাঞ্ছারামপুর বাণিজ্য মেলা: ইতিহাসের গন্ধ মাখা মানুষের মিলনমাঠ - durontobd

সংবাদ শিরোনাম

.jpg

Monday, 17 November 2025

বাঞ্ছারামপুর বাণিজ্য মেলা: ইতিহাসের গন্ধ মাখা মানুষের মিলনমাঠ


জহির শাহ্, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
 

বাঞ্ছারামপুরের শীতল সন্ধ্যা। পৌরসভার ফায়ার সার্ভিস সংলগ্ন মাঠে পা রাখতেই মনে হলো—আমি কোনো বাণিজ্য মেলায় নয়, বরং ইতিহাসের এক জীবন্ত প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আছি। নেক্সুরা ট্রেডিং কর্পোরেশনের আয়োজনে ১ নভেম্বর শুরু হওয়া এই মাসব্যাপী মেলা যেন আধুনিকতার রঙে রঙিন এক প্রাচীন জনপদ—যেখানে বাজারের শব্দ, মানুষের হাঁক–ডাক, শিশুদের হাসি আর দূর থেকে ভেসে আসা নাগরদোলার ছন্দ—সবকিছু মিলেমিশে যেন এক পুরোনো সভ্যতার প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে আনে।


মেলার ভিড় দেখলে মনে হয়—এ অঞ্চলের মানুষ কেবল কেনাকাটায় নয়, নিজেদের ইতিহাস ও শেকড়ের সাথে পুনর্মিলনে এসেছে। হোমনা, তিতাস, মেঘনা, নবীনগর, মুরাদনগর, আড়াইহাজার, মাধবদী—একা একা সব অঞ্চলের মানুষ যেন এক প্রান্তিক সড়ক ধরে এসে মিলেছে একই প্রাঙ্গণে। এ যেন মুগ্ধতার মহাযাত্রা।


স্টলগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়—একেকটি স্টল যেন একেকটি সময়-সেতু। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, গৃহস্থালী সামগ্রী, ইলেকট্রনিক্স, পোশাক, খেলনা, ফার্নিচার থেকে শুরু করে হস্তশিল্প—সবকিছুই যেন এই অঞ্চলের বাণিজ্য ঐতিহ্যের সমসাময়িক রূপ। আয়োজক মীর মোশাররফ হোসেন বকুল বললেন—“৭০টি স্টল আর চারটি প্যাভিলিয়ন এসেছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে।” কথা শুনে মনে হলো—যেভাবে শত শত বছর আগে সারা উপমহাদেশের বণিকেরা গ্রামাঞ্চলের মেলায় জড়ো হতো, আজও সেই রীতি অটুট।


বাচ্চাদের হাসি আর খেলনার শব্দে চারপাশ ভরে আছে। নাগরদোলা, নৌকা, ড্রাগন ট্রেন, মিনি রাইড—এসব দেখে মনে পড়ে যায় পাল পাড়ি দেওয়া মেলা আর মৃৎশিল্পের গ্রামের গল্প—যেখানে খেলাই ছিল শিশুর প্রথম শিক্ষা, আর মেলাই ছিল তাদের প্রথম পৃথিবী দেখা।


খাবারের স্টলগুলো যেন স্বাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—ফুচকা, চটপটি, বার্গার, তান্দুরি চায়ে ভরপুর। তান্দুরি চায়ের ধোঁয়া উড়তে দেখে মনে হলো—হাজার বছরের পুরোনো কোনো পথের ধারের ভ্রাম্যমাণ বণিকের গল্পের ভেতরে ঢুকে পড়েছি।


শীতের পোশাক, জিন্স, শাড়ি, রাইস কুকার, প্লাস্টিকের সামগ্রী—যে স্টলে যাই, মানুষের ভিড় এক কথায় অভূতপূর্ব। কয়েকটি স্টলে তো পা ফেলার জায়গাই নেই। ছোট ব্লেজার স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হলো—এটাই এক আধুনিক যুগের “ক্ষুদ্র বাণিজ্য–কেন্দ্র”—যেখানে মানুষের ব্যস্ততা, দরদাম, হাসি, উচ্ছ্বাস—সব মিলে এক সময়ভ্রমণের অনুভূতি দেয়।


হোমনা থেকে পরিবার নিয়ে আসা মামুন বললেন—“বাচ্চারা জেদ করায় এসেছি। আজ শুধু ঘুরছি। শেষদিকে কেনাকাটা করবো।”

নবীনগরের শিক্ষক সালমা বেগমের কাছে মেলা মানে—পরিবারের সবার জন্য কিছু না কিছু কেনা, কিছু না কিছু স্মৃতি নিয়ে যাওয়া।

কলেজছাত্র আসিফ বলল—“বন্ধুদের সাথে শুধু হাওয়া খেতে এসেছি। মেলার শব্দটাই আলাদা।”


গৃহস্থালীর বিক্রেতা আবদুর রহমান বললেন—“ভিড় স্বাভাবিক, কিন্তু আজ যে পরিমাণ মানুষ এসেছে—এটা আমাদের কল্পনার বাইরে।”

খেলনা বিক্রেতা জহির আহমেদ মনে করেন—“মেলার প্রাণই হলো মানুষ। যত মানুষ আসবে, মেলা তত বাঁচবে।”


একজন প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে মেলাকে দাঁড়িয়ে দেখলে পরিষ্কার বোঝা যায়—বাঙালির মেলা শুধু বাণিজ্যের জায়গা নয়; এটি এক ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্মৃতিস্থান। এখানে মানুষ শুধু পণ্য হাতে নিয়ে ফেরে না—ফেরে এক টুকরো সময়, একটুখানি শেকড়ের ছোঁয়া, আর মিলেমিশে থাকার একটা প্রাথমিক রূপ নিয়ে।


এই মেলা স্থানীয় অর্থনীতিকে চাঙা করবে—এটা তো নিশ্চিত। তার চেয়েও বড় কথা—এটি মানুষকে তাদের ইতিহাসের কাছাকাছি টেনে আনে। মানুষকে মনে করিয়ে দেয়—আমরা যেখানেই যাই, যত আধুনিক হই, আমাদের শেকড় থাকে ঠিক এমনই মেলাময় মাঠে, ভিড়ের শব্দে, নাগরদোলার আলোতে, আর মানুষের নিরন্তর যাত্রার পদচিহ্নে।