জহির শাহ্ | বিশেষ বিজ্ঞান প্রতিবেদন
নরওয়েজিয়ান মেটিওরোলজিক্যাল ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের যৌথ “ফিউচার ক্লাইমেট অব বাংলাদেশ (২০২৫)” বিশ্লেষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু ঝুঁকি দ্রুত বাড়ছে। সিএমআইপি৬-এনইএক্স-জিডিডিপি ডেটার ভিত্তিতে তৈরি উচ্চ নির্গমন সিনারিওগুলো দেখাচ্ছে—২০৪১–২০৭০ সময়ে দেশের গড় তাপমাত্রা ১ থেকে ২ ডিগ্রি এবং শতাব্দীর শেষে ৪.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা দিনের তুলনায় দ্রুত বাড়বে, বিশেষত উত্তরাঞ্চলে যেখানে বৃদ্ধির হার ৫ ডিগ্রি ছাড়াতে পারে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে প্রি-মনসুন তাপপ্রবাহ তিনগুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে এবং পশ্চিমাঞ্চলে প্রতি মৌসুমে ১৫–২৫ দিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা দেখা দিতে পারে। ঢাকায়ও প্রতি বছর বর্ষার আগে ও পরে কমপক্ষে দুটি তীব্র তাপপ্রবাহ ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, তীব্র তাপ শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ২০–৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে।
অন্যদিকে, বৃষ্টিপাতের ধরনও বদলে যাবে—২০৭০ সালের মধ্যে বার্ষিক বৃষ্টিপাত বাড়বে গড়ে ১১৮ মিলিমিটার, আর শতাব্দীর শেষে ২৫৫ মিলিমিটার। উত্তর–পূর্বাঞ্চল সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হবে যেখানে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত ৫৫০–৬০০ মিলিমিটারে পৌঁছাতে পারে। এতে বন্যা, নদীভাঙন ও ভূমিধসের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়বে। একই সময়ে, উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের জন্য বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বেশি—৩.৮ থেকে ৫.৮ মিলিমিটার/বছর। ২১০০ সালে বঙ্গোপসাগরের গড় বৃদ্ধি ০.৭৭ মিটার হলে দেশের ১২–১৮ শতাংশ ভূমি স্থায়ীভাবে পানির নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে, এবং সুন্দরবনের ২৩ শতাংশ এলাকা ডুবে যেতে পারে। ২০৫০ সাল নাগাদ ৯–১৮ লাখ মানুষ স্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে, আর শতাব্দীর শেষে এই সংখ্যা ৫০ মিলিয়ন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। গত চার দশকে উপকূলীয় লবণাক্ততা ২৬ শতাংশ বেড়েছে, যা ১০৫ মিলিয়ন হেক্টর জমি প্রভাবিত করছে এবং ফসল, পানীয় জল ও মিঠাপানির মাছের ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি ফেলছে।
কৃষিতে এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি—ধান ও গমের ফলন তাপমাত্রা ও স্যালিনিটির কারণে ১০–৩০ শতাংশ কমতে পারে। গবাদিপশু ও মাছের উৎপাদনও কমবে, এবং খাদ্যনিরাপত্তা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে। জনস্বাস্থ্যে হিটস্ট্রোক, কার্ডিওভাসকুলার রোগ, ডেঙ্গু–ম্যালেরিয়া–কলেরা ও স্যালিনিটি সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা বাড়বে। শুধুমাত্র চরম তাপমাত্রার কারণে শিশু স্টান্টিং ৫৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে বলে রিপোর্টে উল্লেখ রয়েছে। ২০১৭ সালের বন্যার মতো পরিস্থিতিতে শত শত স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও টিউবওয়েল পুনরায় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অর্থনৈতিক ক্ষতিও বিশাল—জলবায়ু পরিবর্তন এখনই বছরে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি করছে এবং দেশের জিডিপি ১–২ শতাংশ কমিয়ে দিতে পারে। শহরে জলবায়ু–শরণার্থীর সংখ্যা বাড়ছে; ঢাকার অর্ধেক বস্তিবাসীই জলবায়ুজনিত কারণে বাস্তুচ্যুত। গবেষকেরা বলছেন—নির্গমন হ্রাস, উপকূলীয় সুরক্ষা, আধুনিক আগাম সতর্কতা, লবণ-সহিষ্ণু ফসল ও ফ্লোটিং কৃষি ছাড়া পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হবে।
বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এবং ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান ২০২৩–২০৫০ এই পরিবর্তন মোকাবিলার জন্য নীতিগত কাঠামো দিচ্ছে, তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন—“সময় আর হাতে নেই; বাস্তবায়নই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।”
